পর্তুগালে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় সেজদা নামক ‘গুজব টাওয়ার’

65

‘পর্তুগালে বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিলে পর্তুগিজরা আর কথা বলতে চায় না। কারণ, কিছু বাঙালি কুলাঙ্গারদের জন‍্য সব বাঙালি অসম্মানিত হচ্ছেন।’ পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে এমনটাই বলছিলেন রায়হান নামের এক প্রবাসী বাংলাদেশী। শুধু তাই নয়, প্রবাসে হাতে গোণা কতিপয় দালাল প্রতারণাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, প্রবাসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াতেও দ্বিধাবোধ করে না! এমনই এক প্রতারক চক্রের নাম সেজদা টাওয়ার। এটির পরিচালনা দায়িত্বে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহেদুল ইসলাম, আকিব রহমান এবং সিলেটের সাহেদ আহমেদ তামজিদ।

বাংলাদেশ দূতাবাস পর্তুগাল গত ৩ অক্টোবর ফেসবুক পেজে একটি নোটিশ জারি করে। সেখানে বলা হয়, ‌‌‘‘পর্তুগালে বসবাসরত সকল বাংলাদেশী নাগরিকদের জানানো যাচ্ছে যে, দেশবিরোধী একটি চক্র ‘পর্তুগালের আইএমটি কর্তৃক বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স রুপান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে’ শীর্ষক একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে, যা সম্পূর্ণ অসত্য ও ভিত্তিহীন। পর্তুগালে বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স রুপান্তরের ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বাংলাদেশ দূতাবাস, লিসবন খুব শীঘ্রই পর্তুগালের আইএমটি কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স আরও সহজে রুপান্তরের বিষয়ে আলোচনায় বসবে। ভবিষ্যতে ড্রাইভিং লাইসেন্স রুপান্তর বিষয়ক নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হলে দূতাবাস যথাসময়ে নোটিশ দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করবে। সেই সাথে যেসকল ব্যক্তি বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স রুপান্তর সংক্রান্ত গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে- বাংলাদেশ দূতাবাস, লিসবন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’’

প্রথম পর্ব পড়ুন: পর্তুগালে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে সেজদা নামক ‘কাগজ মাফিয়া’

জানা যায়, সেজদা টাওয়ার নামক দালালচক্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী এ গুজব প্রচার করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস, লিসবন সেজদার মালিক সাহেদুল ইসলামকে ডেকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চায়। সেজদার কর্মচারীরা এই বিভ্রান্তিমূলক গুজব প্রচার করেছে বলে সাহেদুল দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। তবে দূতাবাস তার এ জবাবকে সন্তোষজনক হিসেবে গ্রহণ করেনি। এরপর মূলত: দূতাবাস জনস্বার্থে উক্ত নোটিশ জারি করে। বাংলাদেশ দূতাবাস, লিসবনের প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান আলমগীর হোসেনও নোটিশের বিষয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দূতাবাসের এমন নোটিশের পর দায় এড়াতে অভিযুক্ত তিন কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে একটি নোটিশ জারি করে সেজদা টাওয়ার। সেখানেও প্রতারণার আশ্রয় নেয় সেজদা। বহিষ্কার নোটিশে যাদের নাম রয়েছে, সেসব নামে কোনো কর্মচারী তাদের অফিসে কর্মরত ছিল না। অর্থাৎ দূতাবাসকে বোকা বানিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করতে চেয়েছিল সেজদা টাওয়ার। এ বিষয়ে দূতাবাসের প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান আলমগীর হোসেন বলেন, তারা কাকে বহিষ্কার করল কি করল না, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। তাদের পেজ থেকে গুজব ছড়ানো হয়েছে। সেই হিসাবে এর দায় সেজদার মালিকের। কর্মচারী ওই নামে ছিল কিনা, বা তারা কাকে বহিষ্কার করল কি করল না, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা তাদের কর্মচারী সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য গ্রহণ করিনি।

বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে সেজদার প্রতারণার বিষয়ে সংবাদ প্রচার হলে ওই খবর পর্তুগালে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়ে ব্যবসা শূন্যের কোটায় নেমে আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে একটি লাইভ করেন সেজদা কনসালটেন্সির সাহেদ আহমেদ তামজিদ। সেখানে তিনি বলেন, ‘অফিসে একজন স্টাফের সাথে মারামারি হওয়ায়, মারামারি সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। নথি জালিয়াতি সংক্রান্ত কোনো মামলা হয়নি।’ সেফ তাদের নাম উল্লেখ কিছু জানায়নি বলেও তিনি দাবি করেন। তবে সেফের শেয়ার করা ফেসবুক পোস্টের ছবি পর্যালোচনা করে ওই ছবিতে সাহেদুল ইসলাম ও আকিব রহমানের নাম পাওয়া যায়। তারা সেজদা টাওয়ারের মালিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ বিষয়ে দূতাবাসের প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান আলমগীর হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মূলধারার দুই তিনটি সংবাদ আমি দেখেছি। সেখানে যা বলা হয়েছে তা ঠিক আছে। পর্তুগালের ইমিগ্রেশন পুলিশ অভিযোগ পেয়ে সেজদার অফিসে অভিযান চালিয়েছে। মারামারি সংক্রান্ত মামলা হলে তো তারা নথি জালিয়াতি সংক্রান্ত অভিযান পরিচালনা করত না। এখন পর্তুগালের সংশ্লি্ষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ইনভেস্টিগেশন করছে। ইনভেস্টিগেশন শেষ হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

বাংলাদেশবিরোধী গুজব এবং বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করায় সেজদার বিরুদ্ধে আপনারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে দূতালয় প্রধান বলেন, আমরা এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স। বাংলাদেশের সম্মানহানি করলে সে যেই হোক, তা আমরা কোনভাবেই সহ্য করব না। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এ বিষয়ে একমত। এছাড়া অপরাধীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়। আমরা অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা অপরাধীদের প্রশ্রয় দেই না বলেই গুজবের বিষয়টি আমাদের নজরে আসার সাথে সাথেই আমরা নোটিশ ইস্যু করেছি। এখন নথি জালিয়াতির বিষয়টা যেহেতু পর্তুগাল কর্তৃপক্ষ ইনভেস্টিগেশন করছে, নিশ্চয়ই তারা তাদের মতো করে সব নিয়মকানুন মেনে তদন্ত করবে।

উল্লেখ্য, লিসবনে অভিবাসন সংক্রান্ত ভুয়া নথি বিক্রি করার অভিযোগে বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সেজদার অফিসে অভিযান চালিয়েছে দেশটির ফরেন অ্যান্ড বর্ডার সার্ভিস- সেফ। তারা বিদেশি, বিশেষ করে বাংলাদেশি নাগরিকদের বসবাসের অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রতারণামূলকভাবে অবৈধ অভিবাসন এবং নথি জালিয়াতির অপরাধে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পর্তুগাল। অপারেশন ‘রাইট টাইম’ নামে এ অভিযান পরিচালনা করেন সেফ-এর ১০ জন পরিদর্শক। এসময় কয়েকটি কম্পিউটার এবং বিভিন্ন ডকুমেন্ট জব্দ করা হয়। অভিযানের পর সেফ’র ফেসবুক পোস্টে দুটি ছবি শেয়ার করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। ওই ছবিতে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহেদুল ইসলাম ও আকিব রাহমানের নাম সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। এদের সাথে জালিয়াত চক্র পরিচালনায় সিলেটের সাহেদ আহমেদ তামজিদ নামের একজনও রয়েছেন বলে জানা গেছে। সেফ জানায়, প্রতারক চক্রটি একটি কোম্পানির মাধ্যমে মার্টিম মনিজ এলাকায় রুয়া ডো বেনফর্মোসোতে ভুয়া নথি ও কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণা করছিল। এমন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চক্রটির আস্তানা ভেঙে দেওয়া হয়। এছাড়াও সংস্থাটি পর্তুগিজ আবাসিক পারমিট পাওয়ার অনুমতি সংক্রান্ত ভুয়া প্রত্যায়িত নথি সরবরাহ করেছিল।পর্তুগালে অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থা সেফ'র ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট সাহিদুল ইসলাম ও আকিব রহমানের নাম

সেজদা কনসালটেন্সির ব্যানারে তারা অবৈধ ঠিকানা বিক্রি, অবৈধ কোম্পানির কন্ট্রাক্ট বিক্রি, ডুপ্লিকেট ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়া, ৫০০ ইউরোর বিনিময়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি এবং বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিসহ সকল প্রকার অবৈধ সিল ব্যবহার করে ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রসেস করে থাকে। প্রত্যেক লাইসেন্স বাবদ তারা ২-৩ হাজার ইউরো করে নিতো। এভাবেই তারা লাখ লাখ ইউরো হাতিয়ে নিয়েছে।

অভিবাসন সংক্রান্ত এমন নথি জালিয়াতির বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না পর্তুগাল। সেখানকার সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এই বিষয় নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট। এমন প্রেক্ষাপটে নথি জালিয়াত চক্রকে পর্তুগালের সংবাদমাধ্যমে ‘পেপার্স মাফিয়া বা কাগজ মাফিয়া’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর ফলে পর্তুগালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অজানা আশংকায় রয়েছেন।