সোনালী লাইফের বরখাস্ত সিইও রাশেদ’র বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, তদন্তের স্বার্থে চেয়ারম্যানের পদত্যাগ

63

বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত কয়েকদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে দেশের অন্যতম বীমা প্রতিষ্ঠান সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির পক্ষ থেকে মূল অভিযোগ সদ্য বহিষ্কৃত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমানের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে কোম্পানির পক্ষ থেকে রাশেদ বিন আমান ও তার দুর্নীতির সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ মোস্তফা গোলাম এমরান বাদী হয়ে রামপুরা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এতে মীর রাশেদ বিন আমান’সহ কোম্পানির সাবেক সাত কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে অর্থ আত্মসাৎসহ হুমকি প্রদানের অপরাধে পেনাল কোড ১৮৬০ এবং দন্ডবিধির ৪০৮/৪২০/৫০৬ ধারায় মামলা রুজু করা হয় (মামলা নং-৪ তারিখ ১১/০১/২০২৪)। এই মামলায় ইতোমধ্যে রাশেদ’সহ সাত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

এই সাত আসামি হলেন- মীর রাশেদ বিন আমান, সোনালী লাইফের সাবেক এইচআর অফিসার ফাতেমা তামান্না সুইটি, হিসাব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা সুমি শেন, সাবেক হেড অব পারচেজ রাজেশ আইস, সাবেক হেড অব ফাইন্যান্স মো. বোরহান উদ্দিন মজুমদার, হিসাব বিভাগের সাবেক ম্যানেজার মো. শিপন ভূঁইয়া ও সাবেক হেড অব ইনভেস্টমেন্ট সুজন তালুকদার।

তবে কোম্পানির আভ্যন্তরীণ প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে আপাতত ৯ কোটি টাকার আত্মসাৎ এর অভিযোগে মামলা করা হলেও মীর রাশেদ এর আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ বিপুল। মীর রাশেদ এর দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে সোনালী লাইফের পক্ষ থেকে একটি আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের তদন্তে রাশেদ এর বিরুদ্ধে সোনালী লাইফের ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছে কোম্পানির একটি বিশ্বস্ত সূত্র।সূত্রের দাবি, রাশেদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর আরেকটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে কোম্পানিটি।

যদিও শুরু থেকেই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন মীর রাশেদ বিন আমান। উল্টো নিজের অপরাধ ঢাকতে মিথ্যা অভিযোগ করছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান’সহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আর তাতে ছয় লাখেরও বেশি গ্রাহকের আস্থার প্রতিষ্ঠানটির সুনাম পড়েছে হুমকির মুখে। যদিও সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলছেন, মীর রাশেদের দুর্নীতির কারণে তারা কোনোভাবেই গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবেন না।

কেঁচো খুড়তে গিয়ে বেরিয়ে এলো সাপ
ভালোই চলছিল সোনালী লাইফ কোম্পানির কার্যক্রম। তবে বিপত্তি বাঁধে হিসাবের গড়মিল বিষয়ে ম্যাবস অ্যান্ড জে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস এর মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে। ওই অভিযোগের পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে সোনালী লাইফ কর্তৃপক্ষ। সেই তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে মীর রাশেদের একের পর এক জালিয়াতি। এ বিষয়ে রাশেদ বিন আমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য না দিয়ে উল্টো হুমকি দিতে থাকেন। বন্ধ করে দেন অফিসে আসা। অন্যদিকে, অর্থ আত্মসাৎ এর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে মীর রাশেদ এর আরেক কালো অধ্যায়। ধরা পড়ে যায় মুখোশের আড়ালে থাকা এক ভয়ংকর নারীলিপ্সু চরিত্র। পাওয়া যায় একাধিক নারীর সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের ছবি ও ভিডিও। ফাঁস হয়ে যায় প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে গোপনে কোম্পানির সাবেক কর্মী ফাতেমা তামান্না সুইটিকে বিয়ের তথ্য। আর তাতেই আরও বেপোরায় হয়ে ওঠেন রাশেদ বিন আমান। নিজের অপরাধ ঢাকতে শুরু করেন পাল্টা মিথ্যা অভিযোগ। আর এজন্য ঢালতে শুরু করেছেন অবৈধ উপায়ে অর্জিত অঢেল টাকা। অর্থের বিনিময়ে নিজের পক্ষে সংবাদ প্রকাশেরও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

পাল্টা অভিযোগ
প্রাথমিক তদন্তে জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় মীর রাশেদ বিন আমানকে বরখাস্ত করে সোনালী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এর পরিচালনা পর্ষদ। গ্রাহকদের আস্থা ও কোম্পানির সুনামের কথা চিন্তা করে তারা বিষয়টিকে প্রকাশ্যে না এনে রাশেদ এর কাছ থেকে টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করার কথা ভাবেন। আর এই সুযোগটির আরও অপ্যবাবহার করেন রাশেদ। ঘটনার মোড় ভিন্ন দিকে ঘোরাতে কোম্পানির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস এবং আরেক পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বসেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে। এই অভিযোগের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিইও হিসেবে মীর রাশেদ বিন আমানকে তার দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছে আইডিআরএ। যদিও তাতেও অফিসে আসছেন না মীর রাশেদ বিন আমান। বরং বিভিন্ন জায়গায় টাকা ঢেলে চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের পক্ষে লবিং।

মীর রাশেদের উত্থান
অস্বচ্ছল ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’র সন্তান মীর রাশেদ বিন আমিন। তার বাবা আমানউল্লাহ আমান ছিলেন চলচ্চিত্রের ফাইটার। তবে পড়ালেখায় ভালো রাশেদ সুযোগ পেয়ে যান অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার। সেখান থেকে ২০০৯ সালে দেশে ফেরেন। অস্বচ্ছল পরিবার থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পছন্দ হয়ে যায় সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের। তিনি ২০০৯ সালে রাশেদের সঙ্গে নিজের বড় মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার বিয়ে দেন। শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অন্যান্য যোগ্যতার মাপকাঠি মেনে ২০১৩ সালে মীর রাশেদের চাকরি হয় সোনালী লাইফে। পদোন্নতি পেয়ে সিইও হওয়ার পরই শুরু হয় তার দুর্নীতির মহোৎসব। অফিসে তৈরি করে ফেলেন নিজের অপকর্মের সহযোগী নেটওয়ার্ক।

সই জালিয়াতি করে অসংখ্য ব্ল্যাংক চেক
১৫০ কোটি টাকা লোপাটের আরও অর্থ আত্মসাৎ এর অপেক্ষায় ছিলেন মীর রাশেদ। দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর এ বছরের ১ জানুয়ারি থেক অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। তবে কোম্পানির জরুরি কাগজপত্রের প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের নানা চেষ্টার পর একদিন অফিসে আসেন মীর রাশেদ। সেদিন তার দপ্তরে পাওয়া যায় সই জালিয়াতি করা অসংখ্য ব্ল্যাংক চেক। মীর রাশেদ যেন বিষয়টি অস্বীকার করতে না পারেন, সেজন্য এ ঘটনা ভিডিও করে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানির বিশ্বস্ত সূত্র।

নারী কেলেঙ্কারী
মীর রাশেদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে ধরা পড়ে একাধিক নারীর সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের তথ্য ও ছবি। যেসব ছবি রাশেদ নিজেই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন পরবর্তী সময় ওইসব নারীদের ব্লাকমেইল করার জন্য। এমনকি রাশেদ অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছেন অফিসের সহকর্মী নারীদের সঙ্গেও। যে তালিকায় রয়েছে রামপুরা থানায় দায়ের করা মামলার আসামী সুমি শেন ও ফাতেমা তামান্না সুইটি’র নাম। এমনকি ঢাকার একটি হোটেলে এবং চট্টগ্রামের একটি হোটেলে রাশেদের নামে বিলাসবহুল রুম সার্বক্ষণিক বুকিংয়ে রাখার তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে। এসব হোটেলে তার বিরুদ্ধে মাদক ও নারী নিয়ে সময় কাটানোর প্রমাণ হাতে রয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

দ্বিতীয় বিয়ে ও বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি
অবৈধ সম্পর্কের এসব তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরেক তথ্য। ২০২১ সালে তিনি গোপনে বিয়ে করেন কোম্পানির কর্মী ফাতেমা তামান্না সুইটিকে। তাকে রাজধানীর মালিবাগে কিনে দিয়েছেন বিলাসহুল ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল গাড়ি। আর ওই ফ্ল্যাটে বসেই অফিসের বাইরে নিজেদের জালিয়াতির নানা কাজ করত রাশেদ ও তার সহযোগীরা। তবে শুধু সুইটির জন্য বিলাসবহুল গাড়ি নয়; রাশেদ নিজেও একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। সিইও হিসেবে তিনি মাসে সাড়ে চার লাখ টাকা বেতন পেতেন, এর বাইরে তার আয়ের আর কোনো উৎস নেই। তারপরও গত কয়েক বছরে রাশেদ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেছেন। যার কোনোটির দাম কয়েক কোটি টাকার কম নয়। এমনকি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। যদিও টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়েছেন এসব ঘটনা। এছাড়া, বছরে একাধিকবার বিলাসবহুল বিদেশ ভ্রমণ করতেন তিনি। এমনকি, অর্থপাচারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় একটি মার্সিডিজ জি ওয়াগন-২০২১ মডেলের গাড়ি এবং চারটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির সূত্র বলছে, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে মাত্র ১৪ হাজার টাকা বেতনে সোনালী লাইফে চাকরি নেন সুইটি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তার আচরণে পরিবর্তন আসে। শুরু করেন বিলাসী চলাফেরা। এরপর হঠাৎই ২০২১ সালের আগস্ট মাসে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এদিকে, প্রাপ্ত তথ্য বলছে ২০২১ সালের মে মাসে গোপনে সুইটিকে বিয়ে করেছেন রাশেদ। এটি সুইটিরও দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্বামীর ঘরে তার এক সন্তান রয়েছে। অন্যদিকে, রাশেদের প্রথম স্ত্রী ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার রয়েছে দুই ছেলে। যাদের বয়স যথাক্রমে ১২ ও ৪ বছর।

চেয়ারম্যানের পদত্যাগ
সোনালী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস শুরু থেকেই গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবেন না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে আসছেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে নিয়োগ করা তৃতীয় পক্ষের তদন্ত এবং রাশেদের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রাহক বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত তার কারণে প্রভাবিত হয়েছে; এমন অভিযোগ যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্য তিনি চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। গত ১৮ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস পদত্যাগ পত্র জমা দেন বলে কোম্পানির ওই বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘স্বচ্ছতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সততা ও সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে আমি পদত্যাগ করেছি। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিরীক্ষা কার্যক্রম নিবির্ঘ্ন করার পাশাপাশি তদন্ত চলাকালীন কোনো প্রভাব বিস্তার না করে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য আমি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছি।’