যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চার বিলিয়ন পাউন্ড ঘুষ নেয়ার অভিযোগের তদন্ত শুরু করবে ব্রিটেন। বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির সঙ্গে জড়িত কথিত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক গণমাধ্যম ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) টিউলিপ সিদ্দিক, তার যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী মা শেখ রেহানা সিদ্দিক এবং খালা বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে শাসন করা ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেছেন, কমিশন জড়িতদের অবস্থান নির্বিশেষে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ব্রিটেনের হাইকোর্টের আদেশের পরে এই তদন্ত শুরু করা হয়েছিল। তদন্তে দাবি করা হয়েছিল যে টিউলিপ সিদ্দিক মোট ১০ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক চুক্তি পেতে সহায়তা করেছিলেন।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রোসাটম নামে একটি রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নির্মাণ করেছিল। ২০১৩ সালে হাসিনা এবং ভ্লাদিমির পুতিন মিসেস সিদ্দিকের উপস্থিতিতে ক্রেমলিনের অভ্যন্তরে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন। বর্তমানে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক তখন একজন শ্রম কাউন্সিলর ছিলেন।
দুদক টিউলিট সিদ্দিকের পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করছে। যার মধ্যে তার খালাতো ভাই সজীব ওয়াজেদ জয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন এবং তার চাচা তারিক সিদ্দিক, যিনি বাংলাদেশে লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আদালতের কাগজপত্রে তাদের নাম ছিল।
তবে টিউলিপ সিদ্দিক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, মার্কিন ওয়েবসাইটে প্রথম প্রকাশিত হওয়া অভিযোগগুলো ‘ভুয়া’।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্যের সাধারণ সম্পাদক এবং টিউলিপ সিদ্দিকের পারিবারিক বন্ধু সৈয়দ ফারুক বলেন, ‘এই গল্পগুলো বানোয়াট।’
তিনি বলেন, এগুলো বর্তমান সরকারের শতভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে হামলা। তারা টিউলিপকে আক্রমণ করছে কারণ সে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি।
জুলাই মাসে সিটি মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে ঘুষের তদন্ত হলো বিতর্কিত একটি বিষয়। তিনি প্রায় ১৪ মাস ধরে লন্ডনের একটি সম্পত্তির ভাড়ার আয় ঘোষণা করেননি বলে সংসদীয় মানদণ্ড মেনে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছিল। সংসদীয় নিয়ম অনুসারে সদস্যদের ২৮ দিনের মধ্যে এই জাতীয় আয় ঘোষণা করতে হবে।
দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতিরোধের দায়িত্বে থাকা এই মন্ত্রী পরবর্তীতে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ‘অসাবধানতাবশত’ ভুলটি করে ফেলেছিলেন।
গত আগস্টে ডেইলি মেইল আরেকটি প্রতিবেদনে পকাশ করেছিল, মিসেস সিদ্দিক দুই বছর আগে ২ মিলিয়ন পাউন্ডের পাঁচ বেডরুমের বাড়িতে চলে যান, যেটি তিনি তার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালার রাজনৈতিক মিত্রের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলেন।
ববি হাজ্জাজ নামে একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করার পর মিসেস সিদ্দিক এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
আদালতের কাগজপত্র বাংলাদেশি মিডিয়ায় সেসময় প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি করা হয়েছিল। যেখানে অভিযোগ করা হয়েছিল মিসেস সিদ্দিক এবং তার পরিবার পারমাণবিক চুক্তিতে ঘুষ নিয়েছেন।
ঢাকা থেকে ১২৮ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ঈশ্বরদী উপজেলায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিটি ২০১৩ সালে ক্রেমলিনে একটি জমকালো অনুষ্ঠানে হাসিনা ও পুতিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেখানে টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা রেহানা ও ছোট বোন আজমিনা উপস্থিত ছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিক ও তার পরিবার এমনকি পরে রাশিয়ান রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে ছবিও তোলেন।
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামে মার্কিন-ভিত্তিক নিউজ ওয়েবসাইটের রূপপুরবিষয়ক নিবন্ধের প্রকাশের পর বাংলাদেশি গণমাধ্যমগুলোও সেটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। যেখানে টিউলিপ সিদ্দিক এবং তার পরিবারের সদস্যদের চার বিলিয়ন পাউন্ড কিভাবে চুরি করা হয়েছিল তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
নথিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের ব্যয়ের ৯০ শতাংশ ক্রেমলিন হাসিনা সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। কিন্তু হাসিনা পরিবার ‘রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করেছে।
নথিতে বলা হয়েছে, সিদ্দিক, হাসিনা ও তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মধ্যস্থতার বিনিময়ে আত্মসাৎকৃত তহবিলের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন। এমনকি দাবি করা হয়েছে, প্রচ্ছয়া লিমিটেড নামের একটি ‘ভুয়া’ কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ৭০৯ মিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত পাচার করা হয়েছে ‘যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে’।
শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামল ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের গুম করার রাজনীতি। অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার অপশাসনের নানা চিত্র তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের একটি আদালত হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তারপর তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ গত মাসে বলেছিলেন যে তার মা বিচারের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত কারণ ‘তিনি কোনো ভুল করেননি’।
কিন্তু হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পাশাপাশি অন্যান্য দুর্নীতির বিষয়ে আদালতে বিভিন্ন কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে।
মিসেস সিদ্দিক অতীতে তার খালাকে একজন ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রশংসা করেছেন, কিন্তু আগস্টে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি।