যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোর ছয় নেতাকে নিয়ে তাদের নির্বাচনী আসন উল্লেখ করে সহায়তা করতে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। আগামী নির্বাচন কবে হবে তাও এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তার আগেই শরিক নেতাদের কয়েকজনকে নিয়ে বিএনপির এ ধরনের চিঠি দেওয়া নিয়ে দল ও শরিকদের মধ্যে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
শরিকদের কেউ কেউ বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের নতুন দল গঠন নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। যার কারণে শরিকদের ধরে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে এখনই তাদের আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়ে ‘একরকম নিশ্চয়তা’ দিতে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। যাতে তারা অন্য কারও প্রলোভনে পড়ে বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ না করেন।
আবার জোট শরিকদের কারো কারো ধারণা, গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই বিএনপি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায়। কিন্তু এ দাবির প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে আসে দলটি। তবে এখনো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করতে বারবার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে দলটির নেতারা। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার শরিকদের চিঠি দিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করার কৌশল নিয়েছে বিএনপি।
তবে, চিঠি না পাওয়া যুগপৎ আন্দোলনের অন্য শরিকরা এটিকে নির্বাচনের আসন বণ্টনের চিঠি হিসেবে মানতে নারাজ। তারা বলছেন, যাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে তারা তাদের নির্বাচনী এলাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেককে স্থানীয় বিএনপি নেতারা বাধা দিয়েছেন– এমন অভিযোগও উঠেছে। যার কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের স্থানীয় নেতাদের চিঠি দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ছয় নেতাকে চিঠি দেওয়ার পর অন্য শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলে বিএনপির পক্ষ থেকে ৬৪ জেলায় একটি কমন চিঠি দেওয়া হয়েছে, যেখানে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এই চিঠির সঙ্গে নির্বাচনের আসন বণ্টনের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব নেতা তাদের এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক জায়গায় স্থানীয়ভাবে এসব নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যার কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে স্থানীয় নেতাদের যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে ৬৪ জেলায়ও একটি কমন চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক নেতাদের তাদের স্ব স্ব জেলার স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক চিঠি পাওয়া এক নেতা বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই বিএনপি এ চিঠি দিয়েছে। তাই আসলে কী কারণে এখন এ চিঠি দেওয়া হয়েছে জানি না। তবে ধারণা করছি বিএনপি হয়ত শরিকদের নিয়ে কোনো শঙ্কার মধ্যে আছে। এ কারণে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার কোনো খবর না থাকলেও এখনই শরিকদের আসন ছাড় দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে এ চিঠি দিয়ে রাখছে।’
বিএনপির আরেক যুগপৎ সঙ্গী নেতা বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দল গঠন করার আলোচনা নিয়ে বিএনপি প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তাদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। তাদের ধারণা, তরুণ এই নেতাদের নেতৃত্বে নতুন দল গঠন হলে বিএনপির জোট সঙ্গীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতারা সেখানে চলে যেতে পারেন। যার কারণে তাদের ধরে রাখতে এখনই আসন ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। আবার নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এখনই শরিকদের নির্বাচনী মাঠে নামিয়ে দিয়েছে তারা। যাতে শরিকরা রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন ইস্যুতে মনোযোগী না হয়ে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল জেএসডির সভাপতি আ স ম রব (লক্ষ্মীপুর-৪, রামগতি-কমলনগর), নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-৪, শিবগঞ্জ), গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি (ঢাকা-১২ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬), গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক (পটুয়াখালী-৩, গলাচিপা-দশমিনা), সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান (ঝিনাইদহ-২ ,সদর ও হরিণাকুণ্ডু), জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এহসানুল হুদা (কিশোরগঞ্জ-৫, নিকলী-বাজিতপুর)-কে নিয়ে গত ২২ আগস্ট বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠি তৃণমূলে পাঠানো হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে এসব শরিক নেতা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাই তাদের সংসদীয় এলাকায় জনসংযোগ ও তার দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা করতে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় এলাকার থানা, উপজেলা বা পৌরসভার বিএনপি এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিষয়টি অবহিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয় জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে।
জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এহসানুল হুদা বলেন, আমার এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা আমাকে সবসময় সহযোগিতা করে আসছেন। এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমার সংসদীয় এলাকার স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সহযোগিতা করতে চিঠি দিয়েছেন, আর কিছু না।
শরিক নেতাদের চিঠি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই তো একটা পরিবার। আমরা সবাই আওয়ামী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। তাই কেউ যেন কাউকে তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করে সেজন্য এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা তো জানেন যে কেউ একটি কাজ করতে গেলে বা কোথাও দাঁড়াতে গেলে আরেকজন এসে বাধা দেয়। সেটি যেন সৃষ্টি না হয়, এজন্য এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। আর এখনো তো আমাদের আন্দোলন শেষ হয়নি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন এখনো চলমান আছে।’
চিঠি না পাওয়া শরিকদের এ নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই বলে উল্লেখ করে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এ সদস্য বলেন, ‘এটি কোনো আসন বণ্টনের চিঠি নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, ‘কাউকে চিঠি দেওয়া, আবার কাউকে না দেওয়া– এটা বিএনপির বোকামি হয়েছে। যার কারণে পরবর্তীতে আরেকটা চিঠি দিতে হয়েছে। মাঝে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে দল এবং শরিকদের মধ্যে। যদিও এতে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। তবে এ চিঠির রাজনৈতিক একটা উদ্দেশ্য তো অবশ্যই আছে।