ইবনে সিনায় এখনও সক্রিয় স্বৈরাচারের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট

বিশেষ প্রতিবেদক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও দীর্ঘদিন আওয়ামী দখলদারদের বিভিন্ন কূটকৌশলে জিম্মি থাকা ইবনে সিনা ট্রাস্টভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও গণহত্যাকারীদের দোসররা বহাল তবিয়তে রয়েছে। বৈরি পরিবেশের অজুহাতে প্রতিষ্ঠানটিতে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা লোপাটসহ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ পরিচয়ে বহু নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় সবখানেই দখলদারিত্ব ও দূর্বৃত্তায়ন বন্ধ হলেও এখানে এখনও স্বৈরাচারের দোসররা বহাল তবিয়তে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এতে যেকোন সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জানা যায়, মানবসেবার ব্রত নিয়ে ১৯৮০ সালের ৩০ জুন অলাভজনক ও স্বাস্থ্য সেবামূলক ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা মীর কাসেম আলী। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেশ সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে যায়। মানুষের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি একের পর এক শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি পায়। ২০১২ সালের ১৭ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় মীর কাসেম আলীর গ্রেফতারের পরপরই পাল্টাতে থাকে ইবনে সিনার গতিপথ। সদস্য প্রশাসন হিসেবে নিয়োগ পান বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. এ. কে.এম সদরূল ইসলাম। এরপরই রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে ইবনে সিনার পরিচালনা পর্ষদ। ইডি, সেক্রেটারিসহ উর্ধতন পদে নিয়োগ পান বিতর্কিতরা। ইডি হিসেবে নিয়োগ পান ফয়েজ উল্লাহ এবং সেক্রেটারি পদে আসীন হন একসময় আর্থিক কেলেংকারির দায়ে চাকরিচ্যুত হ্ওয়া নুরুল করিম। ছাঁটাই হতে থাকেন অন্যান্য সৎ দক্ষ সিনিয়র কর্মকর্তারা। এভাবেই মূলত কেনাকাটাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে শুরু হয় দুর্নীতির মহাযজ্ঞ।

অভিযোগ রয়েছে, সরকার ট্রাস্টের অর্থ নিয়ে যাবে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট নিজেরাই নামে বেনামে কোম্পানি খুলে বিভিন্ন মেডিকেল ইকুইপমেন্ট আমদানি করে তা চড়াদামে আবার বিক্রি করে ইবনে সিনা ট্রাস্টের কাছে। এই অবৈধ কর্মযজ্ঞ সফল করতে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এডমিনে কর্মরত জাহিদুর রহমানকে বসানো হয় পারচেজ ডিপার্টমেন্টের ইনর্চার্জ হিসেবে। যার নতুন নাম ‘সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সদরুল, ফয়েজ ও নুরুল করিম সিন্ডিকেটের। ট্রাস্টের টাকায় তারা একে একে গড়ে তোলেন প্যানাসিয়া ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, আইসিপিএল, মেডিমার্ট লিমিটেড, বিজ আইটি লিমিটেড, হিজলাইন ইউনিসন লিমিটেড, তাইওয়ান বাংলা লিমিটেড।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্যানাসিয়া ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইবনে সিনা ট্রাস্টি বডির সদস্য (অর্থ) কাজী হারুন অর রশিদ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনে সিনা ট্রাস্টের (এমডি) সদস্য প্রশাসন এ.কে.এম সদরূল ইসলাম। এছাড়া ইবনে সিনার সকল প্রতিষ্ঠানের সফট্ওয়্যার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিজ আইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইবনে সিনা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য (অর্থ) কাজী হারুন অর রশিদ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সদস্য প্রশাসন এ. কে.এম সদরূল ইসলাম। মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান বাংলা লিমিটেডের চেয়ারম্যান এ.কে.এম সদরূল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বায়োট্রেডের সোহরাব হোসেন।

উল্লেখ্য, এই তাইওয়ান বাংলা ইবনে সিনা ট্রাস্টের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। বায়োট্রেড এবং সিমেন্সের মতো বড় বড় কোম্পানি/ভেন্ডরের সাথে যৌথ ব্যবসার নামে কোটি কোটি টাকার ডিল- মূলত এসব কোম্পানির মেশিনপত্র, রি-এজেন্ট ইত্যাদি বেশি দামে ক্রয়ে বাধ্য করা হয় ইবনে সিনা ট্রাস্টকে। ট্রাস্টের সিনিয়র কর্মকর্তাদের (এজিএম থেকে ইডি পর্যন্ত) সাথে নিয়ে উপরোক্তসহ আরও বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। যা আইনত বড় ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধ এবং ট্রাস্ট গঠনের মৈালিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের চুড়ান্ত লঙ্ঘন।

অন্যদিকে বর্তমান সদস্য প্রশাসন ড. এ.কে.এম সদরুল ইসলাম ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের (যার ৫১% মালিকানা ইবনে সিনা ট্রাস্টের) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কাজী হারুন অর রশিদ চেয়ারম্যান হিসাবে মোটা অংকের বেতন ভাতা নিচ্ছেন। একজন ট্রাস্টি হিসাবে এটি নিয়মের পরিপন্থী, যা তারা বৈধতার সাথে গ্রহণ করতে পারেন না। এমনকি মেডিমার্ট লিমিটেডের (মেডিসিন এবং ডিপার্টমেন্টাল শপ) চেয়ারম্যান এ.কে.এম সদরূল ইসলাম। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী হারুন অর রশিদ। হিজলাইন ইউনিসন লিমিটেডের কাজী হারুন অর রশিদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সদস্য প্রশাসন এ.কে.এম সদরূল ইসলাম।

এই দুর্নীতির সিন্ডিকেট এবং ট্রাস্টের নৈতিকতা বিরোধী চক্রের সদস্যরা হলেন- ইবনে সিনা ট্রাস্ট এর সদস্য প্রশাসন ড. এ.কে.এম সদরুল ইসলাম, কাজী হারুন অর রশিদ, বোর্ড মেম্বার (অর্থ-বিভাগ), মো. ফয়েজ উল্লাহ, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ইডি), মো. নুরুল করিম, সেক্রেটারি, মো. জাহিদুর রহমান, ডিজিএম এন্ড হেড অব সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, মো. মোস্তাফিজুর রহমান। সিনিয়র এজিএম ও এইচআরডি ইনচার্জ, নূর ই আলম সবুজ, সিনিয়র এজিএম (এডমিন), ইবনে সিনা ট্রাস্ট। মো. শফিকুল ইসলাম, ট্রাস্টের সিনিয়র এজিএম এবং ইনচার্জ, ইবনে সিনা ডি-ল্যাব, ধানমন্ডি ৯/এ, মো. আনিসুজ্জামান, পরিচালক (এডমিন), ইবনে সিনা হাসপাতাল ধানমন্ডি, মো. আমিনুল ইসলাম, এজিএম, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইনচার্জ, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কল্যাণপুর।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এই সিন্ডিকেটের বেপরোয়া আচরণ আর সিদ্ধান্তে অতিষ্ঠ জুনিয়র কর্মকর্তা কর্মচারীরা। অনৈতিক কাজের সহযোগী না হলে বছরের পর বছর প্রমোশন আটকে রাখা হয়। তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের নিয়ম বহির্ভূত বছরে দু’টি প্রমোশনের নজিরও রয়েছে। এমনই একজন কর্মকর্তা হলেন সদরুল ইসলামের প্রিন্স খ্যাত ইবনে সিনা ডায়াগনোস্টিক এন্ড ইমেজিং সেন্টার ধানমন্ডির টানা ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা মো. শফিকুল ইসলাম। যিনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সদস্য প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আ্ওয়ামী লীগ এবং পুলিশের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শতভাগ ডিসকাউন্ট দিয়ে থাকেন। শুধু একজন পুলিশ কর্মকর্তা (আ. লতিফ, সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মোহাম্মদপুর থানা) ও তার পরিবারের সদস্যদের ২৫ এর বেশি নিয়ম বহির্ভূত সুবিধা দেওয়ার বিলিং মানি রিসেটের প্রমাণাদি এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। শুধু তাই নয়, মোহাম্মদপুর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর লতিফের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা আহসান সাদিক পরাগ ওরফে পরাগ মাহামুদকে ইবনে সিনা হাসপাতাল ধানমন্ডির পরিচালক (এডমিন) মো. আনিসুজ্জামান ও এইচআরডি ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইবনে ট্রাস্টের পাবলিক রিলেশনস অফিসার (পিআরও) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জানা যায়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান হলেন ভাইভা বোর্ডের একজন প্রভাবশালী সদস্য, যাকে ম্যানেজ করতে পারলে মেলে সবই। বিশেষ সূত্র জানায়, সাবেক সদস্য প্রশাসন মীর কাসেম আলীর ফাঁসির পরে ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা ট্রাস্টে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন, যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন অনৈতিক কাজের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এছাড়া মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পরপর তৎকালীন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ইডি) সাইফুল আলম খান মিলনকে এক প্রকার জোর করে বের করে দিয়ে চেয়ারে বসেন বর্তমান ইডি ফয়েজ উল্লাহ।

অন্যদিকে বায়োট্রেডের সোহরাব হোসেন ইবনে সিনার যাদেরকে একচ্ছত্র ব্যবসার সুবিধার্থে ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন, তাদের মধ্যে এডিশনাল ডিরেক্টর ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট প্রধান এ এন এম তাজুল ইসলাম, ফয়েজ উল্লাহ, নুরুল করিম, আনিসুজ্জামান এবং জাহিদুর রহমানও রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় থানা এবং প্রশাসনে ম্যানেজ করার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে এই ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও প্রশাসন ম্যানেজের নামে সকল ইউনিট ইনচার্জের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সরিয়েছে এই সিন্ডিকেট। ইবনে সিনা সাভার ব্রাঞ্চের সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মো. সাইফুদ্দিন মাকসুদ সম্প্রতি এক ফেসবুক লাইভে ট্রাস্টের বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর কুকীর্তি সম্পর্কে ৯ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বার্তা দেন, যা পুরো ইবনে সিনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইবনে সিনার সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে এই দুর্নীতিবাজ চক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অন্তপ্রাণ কর্মীরা। সেই সাথে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন তারা।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্তদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি।