সুন্দরবনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি নিয়ে সারাদেশের জনগণই যেন দুই ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে একদল চায় এই প্রকল্পটি শুরু হোক। অন্যদল ক্রমাগত এর বিরোধিতা করে আসছেন।
রামপালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলে তা সুন্দরবনের পরিবেশের উপর ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে দেশের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প যতভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক যে সেটা দিয়ে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। বাস্তবে তা কখনোই সম্ভব না। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবেই ব্যাপকভাবে।’
বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে এ ধরণের বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তাপীয় কর্মদক্ষতা বা ইফিসিয়েন্সি অনুসারে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন প্রকার: সাব ক্রিটিক্যাল, সুপার ক্রিটিক্যাল ও আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল। সাব ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ন্যায় সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, পারদ, সিসা, আর্সেনিক মিশ্রিত বিষাক্ত ছাই ইত্যাদি নির্গত হয়।’
“সাব ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির তুলনায় সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করলে দূষণের পরিমাণ মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ হ্রাস পায়, যা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ দূষণ সামান্যই কমাতে পারে।
এই বিদ্যুৎপ্রকল্প পরিচালনা করতে যে ধরনেরই টেকনোলজি ব্যবহার করা হোক না কেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে শব্দদূষণ হবেই, বিদ্যুৎকেন্দ্র শীতল রাখার জন্য পশুর থেকে পানি গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। ফলে ঢাকার বুড়িগঙ্গার চেয়েও সুন্দরবনের পশুর নদে আরো ভয়াবহ দূষণ ঘটবে। শব্দদূষণ, পানিদূষণ, আলোদূষণ ইত্যাদি ঘটবেই।”
আনু মুহাম্মদ বলেন, “তবে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যখন এত সব কথাবার্তা চলছে তখন বড়পুকুরিয়া কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কেন কথা হচ্ছে না।”
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে কেউ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে গেলেই দেখতে পাবেন পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ উদাহরণ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশের কৃষিজমি কয়লাদূষণে রীতিমতো কালো রঙ ধারণ করেছে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে গেছে, ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে, ফসল ও মাছ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।’
“তাছাড়া বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপালের তুলনায় অনেক ছোট আকারের এবং বড়পুকুরিয়ার পাশে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বিশ্ব ঐতিহ্য বনাঞ্চল নেই। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট, যার মধ্যে আবার কার্যত ১২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটই কেবল চালু থাকে। অথচ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। ফলে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে তার ১০ গুণেরও বেশি ক্ষতি হবে।”
সুন্দরবনের ভেতরে বয়ে চলা নদীতে যে দূষণ সৃষ্টি হবে সে প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সাধারণ নৌযান চলাচলের ফলেই সুন্দরবন ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। তাহলে দূষণকারী কয়লাভর্তি বড় বড় জাহাজ চলাচল করলে কিংবা সেই কয়লাভর্তি জাহাজ যদি কখনো ডুবে যায় তখন সুন্দরবনের কী অবস্থা হবে, তা চিন্তা করাও ভীতিকর।’
“কয়লা ঢেকে পরিবহন করলে বা কিংবা কয়লাবাহী জাহাজের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হলেও জাহাজের কয়লাস্তূপ থেকে চুইয়ে পড়া কয়লা-ধোয়া বিষাক্ত পানি (বিলজ ওয়াটার), অ্যাংকরেজ পয়েন্টে কয়লা লোড-আনলোড করার সময় সৃষ্ট দূষণ, কয়লার গুঁড়ো, জাহাজ-নিঃসৃত তেল-আবর্জনা, জাহাজ চলাচলের শব্দ, ঢেউ, বনের ভেতরে জাহাজের সার্চ লাইটের তীব্র আলো, জাহাজের ইঞ্জিন থেকে নির্গত বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাস ইত্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব থেকেই যাবে নদীর উপর।”