অবৈধ সম্পদ অর্জন: কালিয়াকৈরের সাবেক মেয়র মজিবকে দুদকে তলব

গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরের সাবেক পৌর মেয়র মজিবুর রহমান (৬০)। প্রায় দুই যুগ সময় ধরে পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এসময়ের মধ্যে প্রায় শূন্য থেকে বর্তমানে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। তার এত সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্নে উঠেছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য অবশেষে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করা হয়েছে। একইসাথে তাকে নিজের, স্ত্রী, সন্তান ও তার উপর নির্ভরশীলদের স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির দলিল, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর রিটার্ন ও যাবতীয় সম্পদের রেকর্ডপত্র নিয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে।

জানা যায়, পৌরসভায় একক টেন্ডার বাণিজ্য, ভূয়া ড্রেনেজ ব্যবস্থার নামে প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি টাকা লোপাট, পৌরসভায় জনবল নিয়োগে অনিয়ম, পৌর এলাকায় অনিয়মিতান্ত্রিকভাবে পরিবহন খাত থেকে টোল আদায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি জবর দখল থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম দূর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। এছাড়াও ক্ষমতার অপব্যহার করে সাধারণ মানুষের জায়গা জবর দখল, খাস ও বনের জমি জবরদখল করে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে মেয়র মজিবুরের বিরুদ্ধে।

স্থানীয়রা বলছেন, মজিবুর রহমান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় এমন দৃশ্যমান উন্নয়ন করেননি। নিজে আধিপত্য বিস্তার করে নামে বেনামে হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। তিনি এখন এখানকার অঘোষিত সম্রাট। পৌরবাসী অনেকটা জিম্মি দশায় রয়েছে তার কাছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়র মজিবর রহমান একসময় পরিবহনের ব্যবসা করতেন। এ ব্যবসায় তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেননি তিনি। পরে পরিবহন ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে শেয়ারে শুরু করেন মুরগীর ব্যবসা। মুরগীর ব্যবসাতেও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হন তিনি। এসব ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী জলিলের হাত ধরে শুরু করেন ঠিকাদারি। এ পেশায়ও তেমন সফলতা ধরা দেয়নি তার কাছে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েন তিনি। এসব ব্যর্থতা নিয়ে অনেকটা বেকার ও ভবঘুরে হয়ে যান মজিবুর। তার পিতা শুক্কুর আলী ছিলেন একজন কৃষক। পারিবারিকভাবে তেমন আর্থিক সচ্ছল না থাকলে ও বিএনপির এক সময়ের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে কালিয়াকৈর পৌরসভার প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ পান তিনি। এতেই যেন তার হাতে আলাদিনের চেরাগের দেখা মেলে। এরপর আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি মজিবুরকে। পৌর প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ভবঘুরে মজিবুরের একক আধিপত্য বিস্তার ও পৌরসভার সব কাজ চলে আসে তার নিয়ন্ত্রণে। এরপর হুহু করে বাড়তে থাকে সম্পদের পরিমাণ। পৌরসভার সকল উন্নয়নমূলক কাজ তার নিজস্ব ঠিকাদার দিয়ে করিয়ে সরকারি কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পৌর প্রশাসকের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজে ধরে রাখতে নিজের লোক দিয়ে ফের নির্বাচন স্থগিত করার জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা জটিলতা দেখিয়ে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় পৌরসভার নির্বাচন দীর্ঘদিন বন্ধ রেখে নিজের একক আধিপত্য বিস্তার ধরে দুই হাতে কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার পৌরসভার যাবতীয় কাজ। ২০১১ এবং ২০২২ সালেও তিনি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে মেয়র নির্বাচিত হন। দীর্ঘদীন একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে পৌর এলাকায় একক ছত্রছায়ায় নামে বেনামে শতশত বিঘা জমি ক্রয় করেছেন তিনি। এসব কেনা জমি পরে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। এমনকি সরকারি বনের জায়গা জবরদখল করে পরবর্তীতে সেই জমি শিল্পকারখানার মালিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন মজিবুর।

সরেজমিনে দেখা যায়, কালিয়াকৈর পৌরসভার বক্তারপুর এলাকায় সরকারি বনের জায়গার ভিতরে মেয়রের রয়েছে ২৫০ শতাংশ জমি। একই এলাকায় কালামপুর মডেল পাবলিক স্কুল সংলগ্ন রেললাইনের পাশে রয়েছে ১১০ শতাংশ জমি। এছাড়া পৌরসভার জমিদারবাড়ীর পাশে শ্রীফলতলী ইউনিয়ন পরিষদের পশ্চিম পাশে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাথে শ্রীফলতলী মৌজায় মেয়রের আস্থাভাজন মো.আকরাম আলী গংয়ের নামে পৌনে ২ একর জমি রয়েছে মেয়রের। যার এস.এ নং-১১, আর.এস নং- ২৩০, এস.এ নং-২০ ও আর.এস নং-৮১। পৌরসভার ছোট লতিফপুর সোহেল মিয়ার বিল্ডিংয়ের সাথে রয়েছে ১৫০ শতাংশ জমি, একই এলাকায় লতিফপুর বাগানবাড়ীর সাথে রয়েছে তার ১৫০ শতাংশ জমি, পৌরসভার কালিয়াকৈর বাজার সোনালী ব্যাংকের সাথে ৪ তলা ভবন, কালিয়াকৈর বাজার মেইন রোডের সাথে রাবেয়া সখিনা ক্লিনিকের সাথে লাগোয়া ৫ তলা ভবন এবং হাসপাতালের পেছনে রয়েছে ৫৫ শতাংশ জমি। কালিয়াকৈর পৌরসভার রেললাইনের সাথে লাগোয়া ৩৫০ শতাংশ জমি রয়েছে মেয়র মজিবুর রহমানের।

কালিয়াকৈর পৌরসভার সফিপুর বাজার সংলগ্ন কৃষি ব্যাংকের উত্তর পাশে ৬তলা ভবন রয়েছে মজিবুরের। পৌরসভার চান্দরা হরিণহাটি জামে মসজিদের পূর্ব পাশে রয়েছে ৭ তলা ভবন এবং মসজিদের সাথে লাগোয়া ৫তলা ভবন। চান্দুরা সাভার-টাঙ্গাইল বাইপাসের সাথে রয়েছে ১৫০ শতাংশ জমি। চান্দুরা পল্লিবিদ্যুৎ লিভাটী ফ্যাক্টরির সাথে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ৫তলা ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি টাকার ওপরে। কালিয়াকৈর পৌরসভার লতিফপুরের থানার পাশে এস.টি টাওয়ার নামের ১১তলা বিশিষ্ট ভবনের কাজ বর্তমানে চলমান। মজিবুর রহমানের এছাড়াও বেনামে তার শত শত একর জবরদখলীয় জমি রয়েছে বলে জানা যায়। এরমধ্যে নিজের স্ত্রী আজমেরী বেগমের নামে বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশত একর জমি কিনেছেন তিনি। এমনকি তার বাড়ির কাজের লোকের নামেও বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে মজিবুর রহমান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে কাউকে তলব করতে পারেন। এটা তাদের কাজ। আমি এখনও চিঠি পাইনি। অনেকেই আমাকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছেন। চিঠি পেলে আমি সেখানে হাজির হবো। যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে, সেটি প্রমাণ হয়েছে কিনা সেটি দেখতে হবে। আমি রাজনীতি করি, সেহেতু আমি ভালো নাকি মন্দ সেটি আমার এলাকার জনগণ জানে।