ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের সকল শ্রেণির মানুষই যুক্ত হচ্ছেন ইন্টারনেটের সঙ্গে তখন শুধুমাত্র একটি ওয়েবসাইট কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পেজ খুলে অনলাইন এসকর্ট সার্ভিস (অনলাইন যৌনব্যবসা) নামে যৌনব্যবসা চলছে রাজধানীতে।
প্রশাসনের নজরদারির অভাবে রাজধানী ছাপিয়ে এই ব্যবসা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে আঞ্চলিক শহরগুলোতেও। ‘অনৈতিক’ এই ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে প্রতারিতও হচ্ছেন অনেকে। তবে অবৈধ এ ব্যবসা এখনই নজরদারির মধ্যে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে এগুলো সমাজের জন্য খুবই খারাপ ফলাফল বয়ে আনতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তবে এগুলো বন্ধের জন্য এরইমধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন সংশ্লিষ্টরা।
গুগলে ঢাকা এসকর্ট সার্ভিস কিংবা বিডি এসকর্ট সার্ভিস লিখে সার্স দিলেই দেখা মিলে শতাধিক ওয়েবসাইটের। এসব ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে দেখা যায়, প্রত্যেকটি সাইটেই তরুণ-তরুণীদের ছবি ও তাদের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া। বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বয়স, চুলের রং, উচ্চতা, চোখের রং এবং সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন।
উপরোক্ত বর্ণনায় খদ্দেরদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য লেখা হয় নানা উত্তেজক কথা। জীবনকে উপভোগ করতে চাইলে যোগাযোগের আহ্বান জানিয়ে সিটি অব লাভ নামের একটি ওয়েবসাইটে এক তরুণীর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, ফোন সেক্স ও ইমো অডিও সেক্স প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ টাকা, ভিডিও সেক্স প্রতি ঘণ্টা ১০০০ টাকা। রিয়েল সেক্স আলোচনা সাপেক্ষে। তবে একসঙ্গে দুইজনের বেশি গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছু ওয়েবসাইটে রয়েছে এলাকা ভিত্তিক সার্ভিস। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে রাজধানীর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর ও ধানমন্ডি এলাকা।
প্রিয়দেশ নিউজের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটের ঠিকানায় যোগাযোগ করে জানা যায়, ওয়েবসাইটগুলোর মূল সার্ভিস দুই ধরনের। হোম সার্ভিস ও ওয়েবসাইট মালিকের স্থানে যাওয়া। হোম সার্ভিস নিতে হলে খদ্দেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত টাকার ৫০ শতাংশ পাঠাতে হবে। এরপর যৌনকর্মী বাসায় আসবেন। তার কাছেই দিতে হবে বাকি টাকা। এক্ষেত্রে যৌনকর্মীকে নির্বাচন করতে হবে অনলাইনের ছবি দেখে।
অন্যদিকে দালালদের নিজস্ব স্থানে গিয়েও সেবা নিতে পারবেন খদ্দেররা। এক্ষেত্রে খদ্দেরকে প্রথমে তাদের দেয়া ঠিকানায় যেতে হবে। সেখানে থাকা যৌনকর্মীদের পছন্দ করে ঘণ্টা চুক্তিতে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে পারবেন তারা।
উভয়ক্ষেত্রেই টাকার পরিমাণ সর্বনিম্ন দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেকক্ষেত্রে মাদকেরও ব্যবস্থা করে দেন দালালরা। সেজন্য অবশ্য খরচ করতে হয় বাড়তি টাকা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার। ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসকর্ট সার্ভিস ছড়িয়ে পড়ায় খুব সহজেই অবৈধ যৌনচারে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নিতে গিয়ে প্রতারিতও হচ্ছেন অনেকে। প্রতারিত একাধিক ব্যক্তি সময় নিউজকে জানান, ওয়েবসাইটে এসকর্ট সার্ভিস নেয়াটা নিরাপদ মনে করে যোগাযোগ করেছিলেন তারা। কিন্তু ওয়েবসাইটগুলোর চাহিদা মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠিয়ে পরবর্তীতে কোনো যৌনকর্মীরই দেখা পাননি। অন্যদিকে যৌনকর্মী বাসায় আসার পর ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে নিয়ে গেছেন টাকা-পয়সাসহ সর্বস্ব।
এছাড়া ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করে যারা দালালদের দেয়া ঠিকানায় গেছেন তাদের অনেকেই সঙ্গে থাকা সকল কিছু দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি লজ্জার ও বেআইনী হওয়ায় তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর শতকরা ৮০ শতাংশ শিশুই বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এসব শিশুদের মধ্যে শতকরা ৬৪ শতাংশ ব্যবহার করছে শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য।
দেশে ক্রমাগত ইন্টারনেট ব্যবহারের বৃদ্ধি, বিশেষ করে শিশু তথা ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে যখন ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে তখন অনলাইনে এসকর্ট সার্ভিস বাড়তে থাকার বিষয়টি সমাজের জন্য খারাপ ফলাফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব।
তিনি বলেন, ১৮ বছরের নীচে আমরা যাদের শিশু বলি তাদের মধ্যে বড় একটা গ্রুপ হচ্ছে টিনেজার। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসকর্ট সার্ভিস ছড়িয়ে পড়ায় তাদের এসব অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। তারা যদি এসব কাজে জড়িয়ে পড়েন তবে সেটা সমাজের জন্য খুবই ক্ষতিকর ফলাফল বয়ে আনবে। সমাজের শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটবে সকল ক্ষেত্রেই। পরবর্তীতে বৈবাহিক সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে এগুলো।
আদিকাল থেকে সকল সমাজেই যৌনব্যবসার প্রচলন থাকলেও মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাই এর মূল খদ্দের ছিলেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। আর ইন্টারনেটে এসকর্ট সার্ভিস ছড়িয়ে পড়ায় এসবের সান্নিধ্যে আসছেন সকল বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। এগুলো যে শুধুমাত্র নৈতিক অবক্ষয়ই ঘটাবে এমনটা নয় বরং এরমাধ্যমে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন নানা যৌনবাহিত রোগে। তাই এগুলো বন্ধে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
তবে সরকার চাইলেই এগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেয়া সম্ভব বলে জানিয়ে তথ্য প্রযুক্তিবিদ সালাউদ্দিন সেলিম বলেন, সরকার চাইলে এসব ওয়েবসাইটের ডোমেইন বন্ধ করে দিতে পারে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে ডোমেইন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ইন্টারনিক কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার ডোমেইন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এথনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এসব ডোমেইন বন্ধ করা সম্ভব।
সরকারের পক্ষ থেকে এসব ডোমেইন বন্ধে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি)মাসুদুর রহমান।
তিনি বলেন, আমাদের সাইবার ক্রাইম ইউনিট এসব ওয়েবসাইট বন্ধে কাজ করছে। একইসঙ্গে অবৈধ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারেও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।