এম এ আশরাফ, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ভোলা-বরিশাল নৌ রুটে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চলাচল করে শতাধিক স্পিডবোট। ফিটনেসবিহীন স্পিডবোট, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও অপ্রাপ্তবয়স্ক অদক্ষ চালকের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। গত ৫ ডিসেম্বর অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের কারণে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
এরপর বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ দিন এই রুটে স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এর আগে ২০১৬ সালেও এই রুটে রাতের বেলায় দুই স্পিডবোটের মুখোমুখি সংঘর্ষে তৎকালীন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ডা. গোলাম সরোয়ারের স্ত্রী ও কন্যাশিশু নিহত হন। এই দুটি দুর্ঘটনায়ই চালকদের ভুলের কারণেই হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্প্রতি ৫ ডিসেম্বর দুর্ঘটনায় পাঁচজন মারা যাওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভোলা-বরিশাল রুটে স্পিডবোট চলাচল পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর বোট মালিকদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠক হয়।
বৈঠকে ১১ ডিসেম্বর থেকে যাদের স্পিডবোটের বৈধ কাগজপত্র আছে তাদেরই রুট পারমিট দিয়ে নতুন নিয়মে স্পিডবোট চলাচল শুরু করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ ডিসেম্বর ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া লঞ্চঘাট এলাকা থেকে ১০ জন যাত্রী নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এলাকার আকবর হোসেনের স্পিডবোটটি। বোটের চালক ছিলেন সদর উপজেলার উত্তর চর ভেদুরিয়া গ্রামের সিদ্দিকের ছেলে আলামিন (১৮)। তার বয়স ১৮ বছর বলা হলেও স্থানীয়রা বলছেন তার বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর।
বোটটি কীর্তনখোলা নদীতে প্রবেশের আগেই চালক আল আমিন স্পিডবোটটি চালু রেখেই ভাড়া তুলছিলেন। এ সময় জনতারহাট এলাকায় বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে স্পিডবোট উল্টে যায়। এতে চালকসহ সব যাত্রী নদীতে পড়ে যান। পরে সেখান থেকে স্থানীয়রা কয়েকজন যাত্রীকে উদ্ধার করেন।
তবে চালকসহ চারজন নিখোঁজ থাকেন। তিন দিন পর ৮ ডিসেম্বর চালকসহ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে বরিশাল সদর নৌ-থানা পুলিশ। উদ্ধাররা হলেন চালক আল আমিন (১৮), ইমরান হোসেন ইমন (২৯) ও রাসেল আমিন (২৫)। এ ছাড়া নিখোঁজ সজল দাসের (৩০) মরদেহ গত শুক্রবার পাওয়া যায়।
স্পিডবোট মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রায়ই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সিরিয়াল পাচ্ছেন না এবং এটি তাদের জন্য লাভজনক নয়। এদিকে ভোলা-বরিশাল নৌরুটে ভোলা থেকে চলাচলকারী ৬০-৭০টি স্পিডবোট রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রুট পারমিট রয়েছে ৪০ থেকে ৪২টি বোটের। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত চালক রয়েছেন ৪০ জনের মতো। তবে তাদের মধ্যে ২০-২৫ জন এখন স্পিডবোট চালান। বাকিরা অন্য কাজে চলে গেছেন। সনদধারী চালকরা বেশির ভাগ সময়ই স্পিডবোট চালান না। কারণ দুই-তিন দিন পর পর একেকটি বোটের সিরিয়াল আসে। আর একবার ভোলা-বরিশাল যাতায়াত করলে মালিকপক্ষ চালককে ৬০০ টাকা বেতন দেন, যা দিয়ে একজন চালকের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব না। তাই অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকরাই বেশির ভাগ যাতায়াত করে থাকে।
ভোলা-বরিশাল নৌ রুটে নিয়মিত চলাচলকারী ১০-১৫ জন যাত্রী জানান, সময় বাঁচানোর জন্য তারা স্পিডবোটে যাতায়াত করেন। নিয়ম অনুযায়ী একেকটি স্পিডবোটে আটজন করে নেওয়ার কথা থাকলেও মালিকপক্ষ সব সময়ই ১০ জন করে যাত্রী বহন করে থাকেন। এদিকে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে লাইফ জ্যাকেট ও নেই প্রশাসনের তৎপরতা। কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই চলছে এইসব লাইনের স্পিডবোট।
এদিকে তবে স্পিডবোটের চার-পাঁচজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালিকদের স্পিডবোট থাকলেও প্রকৃত মালিকরা ঘাটের সিরিয়াল পান না। ঘাটের সিরিয়াল বণ্টন হয় রাজনৈতিকভাবে।
বিআইডব্লিউটিএ ভোলা বন্দরের সহকারী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ৫ ডিসেম্বর চালকের অবহেলার কারণেই স্পিডবোটটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর পর থেকেই আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। কাগজপত্রবিহীন স্পিডবোট চালানো যাবে না। একই সঙ্গে লাইসেন্স ছাড়া ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক দিয়েও স্পিডবোট চালানো যাবে না।
তবে কর্মকর্তাদের এমন কথা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে নেই তেমন তৎপরতা।