ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। দেড় যুগের বেশি সময় মসনদে থাকা রাজনৈতিক দলটির কর্মকাণ্ড দলীয় নেতাকর্মীদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারা পর্যন্ত দেশ-বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে দৃশ্যত রাজনীতির মাঠে নেই আওয়ামী লীগ। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায়ও নেই দলটির দৌড়ঝাঁপ।
অন্যদিকে, সুদিন ফিরেছে দীর্ঘদিন দমন-নিপীড়নের শিকার হওয়া বিএনপির। এখন রাজনৈতিক মাঠে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। একইসঙ্গে কূটনৈতিক পাড়ায় দলটির মূল্যায়নও বেড়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারা ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি দূতদের সঙ্গে বৈঠক ও চা-চক্রের আমন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন। এক কথায় কূটনীতিক পাড়ায় বিএনপির এখন সুসময় চলছে।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর বিএনপির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইরান, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাতিসংঘ, পাকিস্তান, তুরস্ক, নেপাল, ভূটানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনারদের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সাল থেকে সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বাসভবন ফিরোজায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক ও সৌদি আরবরে রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ ঈসা আল দুহাইলান।
এছাড়া দিল্লিতে নিযুক্ত অস্ট্রিয়ার বাংলাদেশের অনাবাসিক রাষ্ট্রদূত ক্যাথারিনা উইজার ঢাকায় এসে বিএনপির চেয়ারপারসনের অফিসে এসে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন।
তবে সব ছাপিয়ে আলোচনা ছিল ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর নানা কারণে ‘প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী’ অস্থানে থাকা বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভারতীয় হাই কমিশনারের সাক্ষাৎ। গত ২২ সেপ্টেম্বর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রণয় ভার্মা। যা ছিল ২০১৪ সালের পর প্রথম কোনো ভারতীয় কূটনীতিকের বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসা।
গুলশান কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছেন, ২০১৪ পর থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে কিংবা তার বাসভবনে ভারতীয় কোনো কূটনীতিকের পা পড়েনি। তবে বিএনপির দলীয় ইফতার ও চেয়ারপারসনের ঈদের শুভেচ্ছা বিনিয়ম অনুষ্ঠানে অংশ নেয় ভারতীয় দূত।
বিএনপির নেতারা বলছেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। এরমধ্যে ২০১২ সালে তিনি ভারত সফরে যান। কিন্তু ২০১৩ সালে জামায়াতের হরতালের কারণে ঢাকায় সফরত তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেননি খালেদা জিয়া। যার ফলে, ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এরমধ্যে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের নানা উদ্যোগ নেওয়া হলে তা আশানুরূপ ফলাফল আসেনি।
ওই বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চায়। বিশেষ করে এই পরিবর্তনের পর (ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতার পরিবর্তন) নতুন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে, তাদের সঙ্গে তারা ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন… কথা বলেছেন। বিএনপির সঙ্গেও তারা তাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায়। এই সম্পর্কের মধ্যে কী করে আরও সুস্থ ধারা, আরও পজিটিভিটি আনা যায়, সেটা নিয়ে তারা কাজ করতে আগ্রহী।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, ‘কূটনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির গুরুত্ব সব সময় ছিল। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে দেশে এমন একটা সরকার ক্ষমতায় ছিল, যাদের কোনো পররাষ্ট্র নীতি ছিল না। তাদের কথা ছিল, সবাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বায়নের যুগে কোনো একটি দেশ শুধু একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের সম্পর্ক থাকে। সেখানে সব দল, মত, সুশীল সমাজ সবার সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখে এবং রাখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শেখ হাসিনা চেয়েছিল শুধু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। যার কারণে যখন বিএনপির সঙ্গে কূটনীতিকদের মিটিং হতো, তখনি তারা স্থানীয় মিশনগুলোতে লিখিত চিঠি পাঠাতো…। তাদের বিভিন্ন ছবক দেওয়া হতো, যা একটা গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারে না। তখন তো অন্য দেশগুলোকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তাদের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হবে। তারা বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে বসে আছে।
শেখ হাসিনা মেঘা প্রকল্পের নামে কি পরিমাণ দুর্নীতি করেছে তা কূটনৈতিকরা বস্তুত অনুধাবন করতে পারছে উল্লেখ করে শামা ওবায়েদ বলেন, ‘সেই কারণে তারা বুঝতে পারছে যে এখানে ব্যবসা করতে হলে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে হলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে সম্ভব না। কারণ বিএনপি এখানে প্রধান অংশীদারদের একজন। সেটা কূটনৈতিকরা সব সময় অনুধাবন করেন, এখন হয়ত আরও বেশি করছেন।’
গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদের ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মসনদে বসে। এরই মধ্যে ইউনূস সরকার তিন মাসের বেশি সময় পার করেছে। বর্তমান সরকার সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে ঠিক কবে নাগাদ নির্বাচন হবে সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। আর বিএনপি শুরু থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়ে আসছে।
দলটি বলছে, দেশে এখন নির্বাচিত সরকার নেই। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায়। তবে এ সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত জনগণের প্রতিনিধির সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ পরিচালনায় দলটির নীতি কি হবে, পররাষ্ট্র নীতি কি হবে, বাণিজ্য নীতি কি হবে- এসব বিষয়গুলো জানতে চাচ্ছে কূটনৈতিকরা।’
বিশেষ করে বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চায়না, জাপান— তাদের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে ভবিষ্যতে বিএনপির বাণিজ্যনীতি কী হবে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনজীবনে যে সব ইস্যু আছে তা নিয়ে বিএনপির পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাচ্ছে কূটনীতিকরা।
দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্র নীতি ছিল-দেশ এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। মুক্তবাজার অর্থনীতি। বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার ভিত্তি হবে বিএনপির আগামী দিনের পররাষ্ট্র নীতি। পাবলিক এবং প্রাইভেট সেক্টর উভয় ক্ষেত্রে সব দেশকে বিনিয়োগে আগ্রহী করা করা হবে বিএনপির কাজ।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, আমাদের ৩১ দফাই হবে বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি। ফলে, প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার মাধ্যমে আমাদের বিদেশে বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। তখন তারা আরও বেশি বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে। যেহেতু দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার আছে, কূটনৈতিকরা জানতে চাচ্ছে তাদের পরিকল্পনা কি?। বিএনপি এখন সবচেয়ে বড় দল, যারা মাঠে আছে। তারা ক্ষমতায় এলে পররাষ্ট্র নীতি, বাণিজ্য নীতি কী হবে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের নেতারা বলছেন, বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় এলে ৯ দেশকে নিয়ে গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) আবারও পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের জোর দেওয়া হবে। যাতে নিজেদের মধ্যকার আন্তঃসংযোগকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যায়।
শামা ওবায়েদ বলেন, সার্ক নিয়ে অনেক পলিসি হয়েছিল। কাগজে-কলমে অনেক কিছু আছে, কিন্তু বস্তুত কিছু করে নাই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে। ভারত, ভূটান, নেপাল, পাকিস্তান সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সামনে সার্কভুক্ত যেসব দেশ আছে তাদের সঙ্গেও হবে। সার্ককে আবার পুনরুজ্জীবিত করার।
বিএনপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, সার্ক সংগঠনকে কার্যকর করার বিএনপির যে সক্রিয় উদ্যোগ, তার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনীয়তা দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ সংগঠন সার্ক কানেক্টিভিটি অন্যতম। বিশেষ করে সার্কের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এখানে অনুভূতি কিংবা নীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।