চুল কাটাকে কেন্দ্র করে তিন কিশোর খুন

যশোর সদর উপজেলার পুলেরহাট এলাকার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরে তিন কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ, সংঘর্ষ নয়, ওই কিশোরদের বেধড়ক পিটিয়ে হতাহত করা হয়েছে। তবে একে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান চৌধুরী।

শুরুতেই পুলিশ এই ঘটনাকে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বলে দাবি করলেও আহত কিশোররা বলছেন কেন্দ্রের আনসার সদস্যরা তাদের ১৮ জনকে বেঁধে পেটানোর কারণেই এমনটা হয়েছে। ঘটনা বেলা ১২টা/১টার দিকে হলেও কিশোরদের দফায় দফায় স্থানীয় আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে আনা হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর থেকে।

পুলিশ এই হাসপাতাল সূত্র থেকেই থেকেই প্রথম খবর পায়। উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে জানান জেলার পুলিশ সুপার মো. আশরাফ হোসেন।

বর্তমানে ওই উন্নয়ন কেন্দ্রের ১০ জন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে ওই কেন্দ্রে থাকা আনসার সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। কেন্দ্রের একজন তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর প্রকৃত তদন্ত শুরু করে দায়ীদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানান মি .হোসেন।

তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেফতারের পর্যায়ে আমরা নেই। আমরা শুধুমাত্র আহত কিশোরদের অভিযোগ এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যে তথ্য পেয়েছি সেটার ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা করলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করবো। সব তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”

এই ঘটনার সঙ্গে কয়েকটি সরকারি দফতরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা যুক্ত থাকায় খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সহিংসতার সূএপাত

এদিকে ভুক্তভোগীদের পরিবারের অভিযোগ, সংঘর্ষ নয়, ওই কিশোরদের বেধড়ক পিটিয়ে হতাহত করা হয়েছে। নিহত এক কিশোরের অভিভাবক জানান, ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল গত ৩ আগস্ট চুল কাটাকে কেন্দ্র করে।কেন্দ্রের এক কিশোরকে দায়িত্ব দেয়া হয় সবার চুল কাটতে। এতজনের চুল কাটতে কাটতে ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে পড়ায় তিনি এক আনসার সদস্যের চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানান।

পরে সেই আনসার সদস্য ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কের কাছে অভিযোগ করেন ওই কিশোররা মাদকের নেশা করে পড়ে আছে।এরপর তাদের সবাইকে নীচে ডাকা হলে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে কেন্দ্রের কিশোরদের সাথে আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।

সেই ঘটনার জেরে গতকাল ওই কিশোরদের গ্রিলের সাথে বেঁধে বেধড়ক পেটায় আনসার সদস্যরা এবং কোন চিকিৎসা ছাড়াই সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেলে রাখে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীর অভিভাবক।এ ঘটনায় হতাহতের স্বজনরা দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছেন।

সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন

একে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান চৌধুরী।তার মতে, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় যারা আসেন তারা সবাই অপরাধী হওয়ায় এ ধরণের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তিনি দেশ ও দেশের বাইরে কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন।এছাড়া এই কেন্দ্রগুলোয় ১৮ বছরের কম বয়সীদের রাখার কথা থাকলেও এর চেয়ে বেশি বয়সীদের এখানে রাখা হচ্ছে, যার কারণে এই অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে বলে তিনি জানান।

মি. চৌধুরী বলেন, “যারা এখানে আসে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তাদের দ্বারা অপরাধ হয়ে থাকে। আবার ২৪ বছর ২৬ বছর লোকের বয়স ১৮ লিখে দিয়ে এখানে পাঠিয়ে দেয়। তারা অপরাধ করে। কিন্তু যা হয়েছে সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলো সচরাচর হয় না।”তবে দায়িত্বশীলদের গাফিলতি থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি সব অব্যবস্থাপনা দূর করার আশ্বাস দিয়েছেন।

সহিংসতা নতুন কিছু নয়

বাংলাদেশে মোট তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে ছেলেদের জন্য টঙ্গি ও যশোরে দুটি এবং গাজীপুরে মেয়েদের জন্য একটি।এসব শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০১১ সালে এক শিশুকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটে।পুষ্টিকর খাবার না দেয়ায় ২০১৪ সালে কিশোরদের সঙ্গে আনসার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়।ওই সময় নির্যাতিত কিশোররা কেন্দ্রে ভাঙচুর ও ভাঙা কাচ দিয়ে শরীর কেটে প্রতিবাদ জানায়।

অথচ বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছর বা এর কম বয়সী যেসব শিশু কিশোরের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদেরকে জেলে নেয়ার পরিবর্তে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে হবে যেন তারা সংশোধিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।

যে কারনে এসব কেন্দ্র শিশুদের জন্য নিরাপদ হতে পারেনি

এসব শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে শিশু কিশোরদের কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলার কথা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো বলে জানিয়েছেন অপরাধবিজ্ঞানী খন্দকার ফারজানা রহমান।দক্ষ কাউন্সিলর ও জনবলের অভাব, ঠিকমতো খাবার না দেয়া, বয়স ভেদে কিশোরদের আলাদা না রাখা এবং অভ্যন্তরীণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকায় এই কেন্দ্রগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে তিনি জানান।

শিশুদের জন্য এই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো অনিরাপদ হয়ে ওঠার পেছনে মূলত ৪টি কারণ উল্লেখ করেন তিনি।প্রথমত, প্রতিটি উন্নয়ন কেন্দ্রে ধারণ ক্ষমতা দুই গুণ থেকে তিন গুণ বেশি কিশোর কিশোরীদের ঠাই দেয়া হচ্ছে।এ কারণে বয়স ভেদে শিশু কিশোরদের যেভাবে আলাদাভাবে সুরক্ষা দেয়ার কথা সেরকম কোন ব্যবস্থা নেই। দেখা যায় একটি ভবনে ১০ বছর বা তার কম বয়সীদের রাখা হচ্ছে।

আরেকটি ভবনে ১১ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সীদের রাখা হচ্ছে। এতে কম বয়সী শিশুটির শারীরিক নির্যাতনের আশঙ্কা থাকে বলে জানান মিসেস রহমান।দ্বিতীয়ত, এই শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে যে দক্ষ কাউন্সিলরের গাইডেন্স প্রয়োজন সেটা নেই।

তৃতীয়ত, যে পুষ্টিকর খাবার দেয়া উচিত সেটা তারা পায় না। থাকার অবস্থাও ভালো নয়।চতুর্থত, পরিবারের সাথে শিশু কিশোরদের দেখা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এছাড়া তাদের চিত্তবিনোদন বা পড়াশোনারও কোন ব্যবস্থা রাখা হয় না।

এছাড়া সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কেন্দ্রগুলোকে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে রেখেছে বলে তারা জানায়।এসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে স্বাধীনভাবে পরিদর্শন করতে পারেন না সংশ্লিষ্টরা।

সব মিলিয়ে মিসেস রহমান মনে করেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো শিশু বান্ধব নয় এবং এসব কেন্দ্র শিশুদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠতে পারেনি।যশোরে ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ওই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ২৭৭ জন কিশোরকে সংশোধনের জন্য রাখা হয়েছিল। তাদের অধিকাংশ গুরুতর অপরাধের আসামী বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত তিন কিশোরের মধ্যে ২ জন হত্যা মামলার এবং একজন ধর্ষণ মামলার আসামী বলে তারা নিশ্চিত করেছেন।