৫ বছরেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ সরকারি ড্রাইভার মোকসেদুল

আনিসুর রহমান মিঠু, ঠাকুরগাঁও
নিয়োগ পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধাভোগ, বিচারকের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আদালত চত্বরে দোকানঘর লীজসহ নানাভাবে অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে ঠাকুরগাঁও অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকের ড্রাইভার (গাড়ীচালক) মোকসেদুল রহমানের বিরুদ্ধে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় জরাজীর্ণ বসতভিটা থেকে তিনি দৃষ্টিনন্দন বাড়িসহ কয়েক বিঘা জমির মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ঠাকুরগাঁও আদালতের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা তার দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তি চেয়ে বিচার বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অভিযোগে জানা যায়, ২০১৯ সালে নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও উৎকোচের বিনিময়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চাকরী নেন মোকসেদুল। চাকরীতে যোগদানের পর থেকেই অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক গাজী দেলোয়ার হোসেনের নাম ভাঙিয়ে সে আদালত চত্বরের ব্যবসায়ীদের থেকে অর্থ আদায় করে আসছে। শুধু তাই নয়, এক ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বিচারকের নাম ভাঙিয়ে বাজার-সদাই করার কথা বলে টাকা নিয়েছে মোকসেদুল।

আরও জানা গেছে, বিচারকের নাম ব্যবহার করে সে বিভিন্নভাবে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে চাকরিতে যোগদানের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় জরাজীর্ণ বসতভিটা থেকে দৃষ্টিনন্দন বাড়িসহ কয়েক বিঘা জমির মালিক বনে গেছেন মোকসেদুল। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদাধিকার বলে কর্মচারীদের পদোন্নতি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি হওয়ায় ড্রাইভার মোকসেদুল নাম ভাঙিয়ে কর্মচারীদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সুপারিশের মাধ্যমে পদোন্নতি পাইয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

লিখিত অভিযোগে জানা যায়, অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালতের ড্রাইভার মোকসেদুল রহমান বিচারকের নাম ভাঙিয়ে আদালত চত্বরে তার বাবা নূর মোহাম্মদের নামে ফলের দোকান বরাদ্দ নিলেও পরবর্তীতে সেটি কম্পিউটারের দোকান হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়া ভগ্নিপতির নামেও একটি দোকান ঘর এবং তার নিকটতম আত্মীয়ের নামে জজ কোর্ট ক্যান্টিন লিজ নেয়। দীর্ঘদিন জেলা জজ অনুপস্থিত থাকায় সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আদালত চত্বরে অস্থায়ীভাবে বেশকয়েকটি দোকান ঘর গড়ে তোলার অনুমতি দেয় মোকসেদুল। একক প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর ধরে লিজ নেয়া ব্যক্তিদের বরাদ্দ বাতিল করে স্বজনদের নামে করে নেন। আর বরাদ্দ বাতিলকৃতরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

৫ বছরের মাথায় জরাজীর্ণ বসতভিটা থেকে ড্রাইভার মোকসেদুলের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি

ভুক্তভোগীরা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে আদালত চত্বরে দোকান ঘর লিজ নিয়ে ব্যবসা করে আসলেও কেউ কোন কিছু বলেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের লিজ বাতিল হয়ে যায়। ড্রাইভার মোকসেদুল জজ সাহেবকে ভুল বুঝিয়ে লিজ নেয়া দোকান ঘরের বরাদ্দ বাতিল করেছে বলে অভিযোগ তুলেন তারা। তাদের অভিযোগ, এটা আমাদের সঙ্গে খুবই অবিচার করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে যে অবিচার হয়েছে তা নতুন জজ সদয় দৃষ্টিতে নিবেন বলে আশা করি।

জানা যায়, আদালতে চাকরী নেওয়ার পর থেকেই যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন করতেন মোকসেদুল। যৌতুক না দিয়ে পরকিয়ায় বাধা দেয়ায় স্ত্রী আফরোজা বেগমের উপর চলতো নিয়মিত নির্যাতন। এমনকি স্ত্রীর অমতে জোরপূর্বক গর্ভপাত ঘটায় বলেও অভিযোগ ওঠে। সেসময়ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলে নিরুপায় হয়ে স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে ৭ লাখ টাকা এনে দিলেও ২০ লাখ টাকার দাবিতে থামেনি নির্যাতন। এসবের প্রতিবাদ করায় চাকরিস্থলের প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিচারকের এজলাস কক্ষে ডেকে জোরপূর্বক স্ত্রীকে তালাক দেয়। স্বামীর বিচার চেয়ে থানা-পুলিশের দারস্ত হয়েও পাননি বিচার। পরে কোন উপায় না পেয়ে যৌতুক ও পরকিয়ায় বাধা দেওয়ার কারণে স্ত্রীকে নির্যাতন, পুলিশ মামলা না নেওয়ার অভিযোগ ও স্বামী মোকসেদুল রহমানের বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন তার স্ত্রীর পরিবার। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও বিচারাঙ্গণে যেন একটি ত্রাসের নাম ড্রাইভার মোকসেদুল রহমান।

এক অভিযোগকারী জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের বিচারাঙ্গণে এখনও যেন একটি ত্রাসের নাম ড্রাইভার মোকসেদুল রহমান। এমন কোন অপরাধ নেই যেটা সে করে না। অন্যায়ভাবে কয়েকজন দোকানিকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নিজের পরিবারের নামে দোকান বরাদ্দ নিয়েছে। ক্যান্টিনের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেটা আদালতের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এতো কিছুর পরেও কিভাবে সে বহালতবিয়তে থাকে? তার সব অপরাধ কি মাফ? যেখানে কোন কর্মচারী তাদের সারাজীবন চাকরী করে একটি দোকানও বরাদ্দ নিতে পারেনি, সেখানে ড্রাইভার মোকসেদ পাঁচ বছরের চাকরী জীবনে তার পরিবারের তিনজন সদস্যের নামে তিনটি দোকান বরাদ্দ পেয়ে গেল। অনুসন্ধান করলে পাঁচ বছরে সে কী কী করেছে তা সব বেড়িয়ে আসবে।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ড্রাইভার মোকসেদুল রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার নামে যে সকল অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা-বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ ফরিদুল ইসলাম জানান, এই আদালতে নতুন যোগদান করায় সেভাবে আমি কিছুই বলতে পারছি না। তবে ড্রাইভার মোকসেদুল রহমানের বিষয়ে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে।

এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আবুল মনসুর মিঞার সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।