চোরাচালান সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের জেরে কলকাতায় বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে। ভারতীয় একটি সূত্র বলছে, এমপি আনার মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে কয়লাসহ নানাবিধ চোরাচালানের সাথে জড়িত ছিলেন। ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত পি এ সাঙমার মেয়ে কল্যাণ সাঙমা তাকে এই চোরাচালানে সহযোগিতা করতেন। সেসব নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্বে এমপি আনার ভারতে খুন হতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে। তবে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এমপি আনারের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ তদন্তে কাজ করে যাচ্ছে।
ভারতীয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ঝিনাইদহ -৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার স্মাগলিং জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিলিগুড়িতে শিলা নামে এক ভারতীয় মহিলা স্মাগলারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। এছাড়া ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত পি এ সাঙমার মেয়ে কল্যাণ সাঙমার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের পাচার গ্যাংস্টার এনামুল হকের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল।
‘এমপি আনার কয়লা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। মেঘালয়ের গাছুয়াপাড়া বর্ডার দিয়ে বৈধভাবে কয়লা পাঠানোর পাশাপাশি অবৈধভাবেও পাঠাতেন। এ ব্যাপারে কল্যাণ সাংমা তাকে সহযোগিতা করতেন। বরাবরই চিকিৎসার নামে কলকাতা এসে রাজারহাট নিউটাউনের সঞ্জিতা গার্ডেনে উঠতেন এমপি আনার। এখান থেকে দুই দেশের মহিলা স্মাগলার, বিএসএফ অফিসার ও কাস্টমস অফিসারদের সঙ্গে তিনি দেখা করতেন। মাঝেমাঝে তিনি শিলিগুড়ি যেতেন। আসাম ও মেঘালয় যেতেন’, এমনটাই জানাচ্ছে ভারতের সূত্র।
কলকাতার সূত্র জানায়, ওই ফ্ল্যাটে কয়েক টুকরো করা হয়েছিল এমপি আনারের মরদেহ। তিহার জেলে থাকা ভারতীয় এক স্মাগলারের ভাগ্নেদের সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল এমপি আনারের। মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান হতো তাদের। সেসব বিষয় নিয়ে খুন হয়ে থাকতে পারেন এমপি আনার।
এছাড়া ঝিনাইদহের একাধিক মার্ডার সংক্রান্ত প্রতিশোধের বিষয়ও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে বলে জানা গেছে। ভারতীয় আরেকটি সূত্র জানায়, কলকাতায় এমপি আনারের ভাড়া বাসায় একাধিক লোক উপস্থিত ছিল। সেখানে ২০০ কোটি টাকার একটি বিজনেস ডিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরই খুন হন এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার।
ভারতে গিয়ে নিখোঁজ এমপি আনার যে খুন হয়েছেন, সেটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও স্বীকার করেছেন। বুধবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতে খুন হয়েছেন। তবে তার মরদেহ এখনও উদ্ধার হয়নি। হত্যার সঙ্গে জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসার জন্য আনোয়ারুল আজিম দেশের বাইরে গিয়েছিলেন সেখানে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের নিশ্চিত করেছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের কাছে আরও তথ্য আছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন জানাতে পারছি না। কোথায় খুন হয়েছে, কীভাবে খুন হয়েছে, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে তদন্ত শেষে সবকিছু জানানো হবে।
অন্যদিকে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বুধবার দুপুরে বলেছেন, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছি। তবে ইন্ডিয়ান বা কলকাতা পুলিশ সংসদ সদস্যের মৃত্যুর বিষয়ে সরকারিভাবে আমাদের এখনো কিছু নিশ্চিত করেনি। আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। তাদের তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে বেশি কিছু না বলাই শ্রেয় হবে।
এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের বিরুদ্ধে হুন্ডি, নারী পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসম্পর্কে কোনো তথ্য পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে পুলিশ প্রধান বলেন, এই মোটিভ নিয়ে ইন্ডিয়ান পুলিশ কাজ করছে। আমরাও কাজ করছি। এ ব্যাপারে এখনি কোনে মন্তব্য করার সময় হয়নি। যথা সময়ে এটা পরিষ্কার হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত আট দিন ধরে নিখোঁজ থাকলেও তার ফোন থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে মেসেজ পাঠানো হয় যে সে নয়াদিল্লি চলে গেছে। এরপর জানা যায়, তিনি ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনের একটি বাড়িতে যান, সেই বাড়িতেই তাকে খুন করা হয়। নিউটাউনে যে বাড়িতে তিনি গিয়েছিলেন সেটা একজন এক্সাইজ অফিসারের। ধারণা করা হচ্ছে, ভাড়া নেওয়া বাড়িতে ডেকে এনে খুন করা হয়েছে এমপি আনারকে। খুনের দিন এই বাড়িতে মহিলাসহ একাধিক লোকজন ছিলেন বলে জানিয়েছে কলকাতার একটি সংবাদ সংস্থা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যার ঘটনা খুবই দুঃখজনক, মর্মান্তিক, অনভিপ্রেত। কলকাতা পুলিশ যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে, সেখানে ঢুকেছিল। কিন্তু লাশ সেখানে পায়নি। হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিবি গ্রেফতার করেছে। কলকাতা পুলিশও দুজনকে গ্রেফতার করেছে। তদন্ত চলছে, কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানাবে। আমরা হাইকমিশনের মাধ্যমে খোঁজ রাখছি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। ঝিনাইদহ-কালিগঞ্জ এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তার এলাকার সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, এটা মনে করেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।
ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, এমপি আনার এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। এজন্য তিনি পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে ছিলেন। যেকোন বিপদে সহযোগিতা প্রয়োজন হলে এমপি আনার কখনোই কাউকে না করতেন না। সংসদ সদস্য এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে ওঠেন আনোয়ার উল আজিম আনার। এরপর থেকে আর তার খোঁজ মেলেনি। ফোন করলেও বারবার রিং হয়ে কেটে যায়। সাংসদের শেষ মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছিল ভারতের বিহারে। গত ১৪ মে থেকে তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, গত আট দিন ধরে নিখোঁজ থাকলেও তার ফোন থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে মেসেজ পাঠানো হয় যে সে নয়াদিল্লি চলে গেছে। এরপর জানা যায়, তিনি ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনের একটি বাড়িতে যান, সেই বাড়িতেই তাকে খুন করা হয়।
কলকাতায় গিয়ে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ারুল আজিম (আনার) এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার ২২ মে এক শোক বার্তায় শেখ হাসিনা মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।