বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিবেদক: ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবেক চীফ হুইপ স্থানীয় এমপি আ.স.ম ফিরোজ বলেন, শিক্ষিত জনপদ বাউফলে বিগত বিশ-ত্রিশ বছরে এরকম অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখিনি। কয়েক বছর ধরে অবৈধ অস্ত্রে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। অবৈধ অস্ত্র ও মূল হোতাদের ধরতে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। আশা করি তারা দ্রুতই পদক্ষেপ নিবেন।
প্রিয়দেশ নিউজে কয়েকদিন আগে পটুয়াখালীর বাউফলে কয়েক বছর ধরে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়ছে বলে নিউজ প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হয়ে আসছিল। অহরহ ঘটছে অস্ত্র প্রদর্শন, ফাঁকা গুলি ও হতাহতের ঘটনা। সম্প্রতি বড় ভাইয়ের অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে প্রতিবন্ধী ছোট ভাই নিহত হওয়ার ঘটনা আবারও আলোচনায় অবৈধ অস্ত্র। বিগত দিনের ঘটনায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিক মহল।
থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৯ মার্চ উপজেলার সূর্যমণি গ্রামে বড় ভাই সজিব হোসেনের (২২) অবৈধ পিস্তলের গুলিতে নিহত হন ছোট ভাই সাব্বির(১৩)। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত সজিবকে আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের রান্না ঘরের গাছের শুকনো পাতার বস্তা থেকে গুলিভর্তি বিদেশী রিভলবার (পিস্তল) উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত সাব্বির ও অভিযুক্ত সজিব সূর্যমণি গ্রামের বাবুল সওদাগরের ছেলে।
অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে আপন ছোট ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় উপজেলা জুড়ে আলোচনার জন্ম দেয় ওই কলেজ ছাত্রের হাতে অস্ত্র এলো কিভাবে। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ গিয়ে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে সাথে কথা হয়।
সূত্রের তথ্য বলছে, সজিব পৌরশহরের নবারুণ সার্ভে অ্যান্ড পলিটেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউটের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র। সে ভাড়ায় মটরসাইকেল চালিয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ বহন করতেন। পৌর শহরে যাতায়াত ছিল তার। এক পর্যায়ে শহরের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠির সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ওই সন্ত্রাসীরা সজিবকে ব্যবহার করে আসছিলেন। ভাড়ায় মটরসাইকেল চালানো আড়ালে সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্ত্র বহন করতেন সজিব। ঘটনার দিন সন্ত্রাসীদের রাখা অস্ত্রে অসাবধনতাবশতঃ টিগারে চাপ পরে গুলি বেড় হয়ে যায়। ওই গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যান ছোট ভাই সাব্বির।
এছাড়াও গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনামে আসে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। এসব ঘটনায় মামলা হলেও উদ্ধার করা হয়নি অবৈধ অস্ত্র।
চলতি বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগা ইউনিয়নে নৌকার উঠান বৈঠক শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল খান। বগা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুপক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। হামলার সময় আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্রে (শটগান) ফাঁকা বুলেট নিক্ষেপ করে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
এ ঘটনায় বগা ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগ সংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদ হাসানসহ ১৫জন আসামী করে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন রেজাউলের ভাই মামুন খান। এখন পর্যন্ত এঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
এর আগে ২০১৮ সালে সদর ইউনিয়নে ছাত্রলীগের সভা চলাচলে হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় হামলাকরীরা স্থানীয় এমপির ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য রায়হান শাকিবের বুকে অবৈধ পিস্তল প্রদর্শণ করে হত্যার হুমকি দেয়। ওই ঘটনায় থানায় মামলাও করা হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
২০২১ সালে নওমালা ইউপি নির্বাচনে প্রকাশ্য অস্ত্রের ব্যবহার দেখায় যায়। একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। সে ঘটনা ব্যবহার করা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় রাজনীতিক বিরোধের জের ও স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে অবৈধ অস্ত্রের মহড়ার অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনা বছরের পর বছর পার হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকারী পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
একাধিক সূত্র আরও জানায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও রাজনৈতিক নেতাদের সুনজরে থাকতেই ব্যবহার হয় এসব অস্ত্র। সন্ত্রাসীরা সাধারণত দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। তবে সম্প্রতি অত্যাধনিক অস্ত্রও তাদের হাতে রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ওয়ান শুটার গান, পাইপ গান, এলজি, একে-২২, আমেরিকান নাইন এমএম পিস্তল, সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ, নাইন এমএম, পয়েন্ট টু টু ও রিভলবার। এছাড়া বিপুলসংখ্যক ম্যাগাজিন, ককটেল, বারুদসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকও রয়েছে তাদের কাছে। অধিকাংশ সময় অস্ত্র পরিবহনে ব্যবহার করা হয় ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যদের।
উপজেলা জুড়ে অস্ত্রের মহড়া, প্রকাশ্য অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেলেও এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিকেরা।
উপজলো সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল আলম মিয়া বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান কোনভাবেই সন্তোষজনক বলা যায়না। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং মাদকের দাপটে সাধারন মানুষ আতঙ্কিত এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছেন।
বাউফল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শোনিত কুমার গায়েন বলেন, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং হত্যার অভিযোগে সজিবের নামে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের হয়েছেন। অবৈধ অস্ত্র মামলার বাদী পুলিশ এবং হত্যা মামলার বাদী অভিযুক্ত সজিবের মা রাশেদা বেগম। দুই মামলায় তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এর আগে হত্যার কাজে ব্যবহৃত গুলিভর্তি ওই অবৈধ অস্ত্রও উদ্ধা করা হয়। তিনি আরও বলেন, সজিবের হাতে ওই অস্ত্র কোথা থেকে আসলো, কারা জড়িত এসব তথ্য উদঘটন করতে আসামী সজিবের ৫দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আদালত শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দিলে প্রকৃত জড়িতদের তথ্য পাওয়া পাবে।
বিগতে দিনে অবৈধ অস্ত্র প্রকাশ্য আসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যোগদান করার পর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। কাজ চলছে। তদন্তের স্বার্থে আর কিছু বলা যাবে না।