বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিবেদক: পটুয়াখালীর বাউফলে বছরের পর বছর ধরে ভাঙছে তেঁতুলিয়া নদীর দুইপাড়। বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি। অব্যাহত ভাঙন কবলিত এলাকায় নেই বালুমহাল। তবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে থেমে নেই একটি প্রভাবশালী মহল। উপজেলার চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চরব্যারেট এলাকায় তেঁতুলিয়া নদীর তলদেশ থেকে আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বালু তুলছেন এ প্রভাবশালীরা। দিনে তোলায় প্রায় ৪লাখ ঘনফুট বালু। আর মাসে তোলা হয় প্রায় ১২ লাখ ঘনফুট। ফুট প্রতি ৮ টাকা দরে যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, তেঁতুলিয়া নদীর চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন, নাজিরপুর ইউনিয়নের ধানদী, নিমদী, কচুয়া ও ধুলিয়া ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যার কারনে এসব এলাকায় বালু মহল ইজারা বন্ধ রয়েছে। শুধু মাত্র বাউফল-দশমিনা সীমানায় বুড়াগৌরঙ্গ নদীর ডুবাচরে ৪ একর এলাকায় জুড়ে বালুমহল ইজারা দেয়া হয়েছে। এর বাহিরে তেঁতুলিয়া নদীর কোনো পয়েন্টে বালুমহাল নেই।
তবে বালুমহাল না থাকার পরেও চরব্যারেট এলাকায় থেকে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক হিসাবে বালু তোলা হচ্ছে। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অপরদিকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় তেঁতুলিয়া নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাড়ছে নদী ভাঙনের তীব্রতা।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক মো. ফয়সাল বলেন, নদীর তলদেশ থেকে বালু অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। যার মধ্যে স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের আবাসস্থল এবং তাদের খাদ্যের উৎস ধ্বংস হচ্ছে। ফলে ইলিশসহ মৎস্য প্রজনন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। অপরদিকে বালু উত্তোলনে নদী গর্ভের গঠন প্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। পুরো হাইড্রোজিক্যাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কাছাকাছি মাটির ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি মাটির গুনাগুণও নষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলছে এ অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন।
বালু তোলা ও পরিহবনের সাথে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বালু তুলছেন ভোলার বোরহান উদ্দিনের যুবলীগ নেতা মোশারেফ হোসেন। বিশালাকৃতির অত্যাধুনিক ৩টি ড্রেজার দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ধরে এ কাজ করে চলছেন তার লোকেরা। এসব ড্রেজার দিয়ে দিনে প্রায় ৪ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হয়। প্রতি ঘনফুট বালু বিক্রি হয় ৮ টাকা দরে। দিনে বিক্রি হয় ৩২ লাখ টাকা। আর প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অবৈধ বালু বিক্রির বিশাল অংকের এ টাকা ঢুকছে বালু খেকো চক্রের পকেটে। এ চক্রের মূল হোতা মোশারেফ হলেও এর সাথে পটুয়াখালী ও ভোলার ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও জড়িত রয়েছেন।
গত ১৩ ডিসেম্বর তেঁতুলিয়া নদীর চরব্যারেট এলাকা থেকে বালু তোলার চিত্র দেখতে সেখানে যান প্রিয়দেশ নিউজ এর এই প্রতিবেদক। ছোট ট্রলার নিয়ে তেঁতুলিয়া নদীর চরব্যারেট সীমানায় গিয়ে দেখা যায় ৩টি ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার কাজ চলছে। পাশাপাশি আল কাবা ড্রেজিং প্রকল্প ও এমবি রাফসান নামে দুইট ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। একটু দূরে ছিল আরও একটি বালু তোলার ড্রেজার। এসময় তেঁতুলিয়ার চরব্যারেট এলাকার কয়েক কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সারি সারি বালু পরিবহণের বলগেট (জাহাজ)। অবৈধ বালু তোলার এ কর্মযজ্ঞের চিত্র ধারণ করতে গেলে মোশারেফ বাহিনীর তোপের মুখে পড়তে হয়। মোশারেফের লোকজন তাদের ট্রলার দিয়ে এ প্রতিবেদকের ট্রলার ধাওয়া করেন।
বালু পরিবহণের কাজে নিয়োজিত এমবি নওরোজ জাহাজের একাধিক শ্রমিক জানান, প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫টি বলগেটে (জাহাজ) করে এসব বালু চলে যায় পটুয়াখালী জেলার পায়রা বন্দর, বাউফল, দশমিনা, গলাচিপা, ভোলা জেলার লালমোহন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
নদীর জেলে ও স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, অবাধে বালু তোলার জন্য মোশারেফের রয়েছে সন্ত্রাসী বাহিনী। বালু তোলার ড্রেজারের আশে পাশে কোনো সাংবাদিক বা জেলে নৌকাও যেতে পারে না। কেউ ড্রেজারের কাছে গেলে তার ওপর হামলা করেন মোশারেফের লোকজন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বালু খেকো মোশারেফের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। তার বাবার নাম আবুল কামাল বরদার। তিনি ওই উপজেলার গঙ্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মোশারেফ দীর্ঘদিন ধরে তেঁতুলিয়া নদীতে মাছে ব্যবসা করে আসছিলেন। গত ৭ মাস ধরে শুরু করেন অবৈধ বালুর ব্যবসা। এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গড়ে তুলেন বিশাল বাহিনী। এছাড়াও ভোলা ও পটুয়াখালীর একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে মাসোয়ারা দেন মোশারেফ।
মোশারেফ হোসেনের কাছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় তেঁতুলিয়া নদী পাড়ের চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চরব্যারেট, চর রায়সাহেব ও চরওয়াঢেল এলাকার প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় জুড়ে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক বছরে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ৩শ একর জমি। ভিটেমাটি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে গেছে শত শত পরিবার। তাদেরই একজন মোতালেব হাওলাদার। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে তিনবার নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে তার পরিবার। এখন তারা নিঃস্ব। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী সন্তান নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৭ বছরে নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে শত শত একর জমি। ভিটেমাটি হারা হয়েছেন শত শত পরিবার। ২ বছর আগে ভাঙন কবলিত এলাকায় একটি নতুন চর জেগে উঠতে শুরু করে। এতে সব হারানো মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে। তবে গত ১ বছর ধরে ও ডুবোচর কেটে বালু উত্তোলন শুরু করে ভোলার বালুখেকো মোশারেফ। বালু উত্তোলনে নিষেধ করলে স্থানীয়দের উল্টো হুমকি ধামকি দেয়। নিজের ভিটে মাটি রক্ষা করতে ৭ মাস আগে মোশারেফের একটি বালু বোঝাই জাহাজ জব্দ করে স্থানীয়রা। পরে তা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। যদিও নামমাত্র জরিমানাই ছিল তার শাস্তি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. জসিম উদ্দিন বলেন, একটি চর জেগেছে। এতে নদী ভাঙন কমবে। কিন্তু সেই চর থেকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ধরে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে। বিষয়টি ইউএনওকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় জনগণ বালুর বলগেটও জব্দ করে। তবুও বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. বশির গাজী বলেন, বালু তোলার বিষয়টি জানি। এ নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সাথেও কথা বলেছি। উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে অবিলম্বে অভিযানে নামব।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. নুর কুতুবুল আলম বলেন, বিষয়টি আপনার কাছ থেকে জানলাম। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।