রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে ৯ হাজার পরিবার

এম. মতিন, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে প্রায় ৯ হাজার বসতঘর। এতে প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ের মাটি ধসে অনেক বসতঘর চাপা পড়ে। ঘটে হতাহতের ঘটনাও। তবে বর্ষা এলেই প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের নেই কোন উদ্যোগ।

চলতি মৌসুমের বর্ষায় গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উপজেলায় বিভিন্ন পাহাড়ে ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেকোন মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা। তবে উপজেলা প্রশাসন পাহাড়ের চূড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতির লোকজনকে অন্যত্র সরে যেতে মাইকিং করে প্রচার চালালেও সরানোর কোন কার্যকরী পদক্ষেপ ও দৃশ্যমান কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। অনেকটা মাইকিং করেই দায়িত্ব শেষ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের কমিউনিটি সেন্টার, জঙ্গল বেতাগি এলাকায় পাহাড় কেটে প্রভাবশালীরা মাটি বিক্রি করছে। একইভাবে উপজেলার উত্তর রাঙ্গুনিয়ার ১ নং রাজানগর, ১৪ নং দক্ষিণ রাজানগরের মুহাম্মদপুর, বাইশ্যাের ডেবা, লেলিঙার টিলা, ১৩ নং ইসলামপুরের মঘাছড়ি, রইস্যাবিল, একই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবুল কালাম নিজেই গাবতল এলাকায় পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরী , ১৫ নং লালানগরের চাঁদের টিলা, ছনখোলা বিল, পেইট্ট্যাঘোনা, আগুনিয়া চা বাগান, হোসনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তাপুর, ফকিরারটিলা, ফুইট্ট্যােগোদা , পোমরা, কোদালা, পারুয়া ইউনিয়নের জঙ্গল পারুয়া, সরফভাটা, শিলক ও পদুয়া ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তৈরি করেছে প্রায় ৮-৯ হাজারেরও বেশি পরিবার। বসবাস করছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

রাঙ্গুনিয়া পৌরসভা কার্যালয় সূত্র জানায়, পৌরসভার অভ্যন্তরে ১০টির বেশি পাহাড়ে ভূমি ধসের ঝুঁকি রয়েছে। এসব পাহাড়ে ৩ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি তৈরি করে বসত করছে ৫ হাজারের বেশি মানুষ।

তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধভাবে অসংখ্য বসতঘর গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করেছে পাহাড় কেটে। আর এসব ঘরে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার। বর্ষা মৌসুমে এলেই প্রশাসন অনেকটা মাইকিং করে দায়সারাগোছের প্রচার চালায়। কিন্তু ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের সরানোর কার্যকরী পদক্ষেপ ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায় না।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার রাঙ্গুনিয়ার সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ জহুরুল আনোয়ার বলেন, ‘বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধভাবে অসংখ্য বসতঘর গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করেছে পাহাড় কেটে। আর এসব ঘরে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন মাইকিং করে দায়সারা ভাবে দায়িত্ব পালন করলে হবে না। পাহাড়ের নিচে অবৈধ বসবাসকারীদের অনতিবিলম্বে সরিয়ে নিতে হবে। উচ্ছেদ করতে হবে অবৈধ স্থাপনা। নতুন করে পাহাড়ের নিচে যাতে কেউ অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলতে না পারে তা প্রশাসনের নজরদারিতে রাখতে হবে।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক মোঃ জসিম উদ্দিন শাহ বলেন, ‘পাহাড় কাটার কারণে পাহাড় ধসের ঝুঁকি বাড়ছে। আগে পাহাড় কাটা রোধ করতে হবে। তাহলে ধসের পরিমাণ কমে যাবে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদাসীনতা রয়েছে। পাহাড়ে অভিযানের পর ফলোআপ করে না বন বিভাগ বা উপজেলা প্রশাসন। বর্ষা এলেই মাইকিং করে দায়িত্ব শেষ করে। আগে থেকেই পরিকল্পনা নিতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের কী করতে হবে।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫ ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় ৯ হাজার একর সরকারি ও ১৫ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি (পাহাড়) রয়েছে। এসব পাহাড়ে প্রায় ৯ হাজার বসতঘর রয়েছে। এরমধ্যে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে আছে অন্তত ২৫-৩০ হাজার মানুষ।

এ প্রসঙ্গে ইছামতী রেঞ্জ কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা কোনো আইন মানে না। তাদের উচ্ছেদ করার পরও আবার বসতি গড়ে।’

এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানী বলেন, ‘পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পাহাড় ছাড়তে অনুরোধ জানিয়ে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এরপরও বসবাসকারীরা স্বেচ্ছায় সরে না এলে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভারী বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে ২ শতাধিক বসতঘর মাটি চাপা পড়েছে। ২০১৭ সালের ১৩ জুন মঙ্গলবার দিবাগত রাতে উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের দুই পরিবারের ২২ জনসহ একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড় কাটার সময় মাটি চাপা পড়ে এক শিশুসহ ৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।