এম.এ হান্নান, বাউফল: পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার সূর্যমণি ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে মো. ফোরকান মোল্লা নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষকের মানবহীন ঘরে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঘর মালিক ফোরকান মোল্লা একই বাড়ির এক প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণ মামলার আসামি। ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের চার সদস্যসহ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন ফোরকান মোল্লা। ধর্ষণ মামলা থেকে বাঁচতে অগ্নিকাণ্ডের নাটক সাজিয়ে ধর্ষণের শিকার তরুণীর পরিবারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ফোরকান মোল্লার বিরুদ্ধে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রামনগর গ্রামের প্রতিবন্ধী বাবুল মোল্লা (৫৫) ও ফোরকান মোল্লা (৫৫) একই বাড়ির বাসিন্দা। পাশাপাশি ঘর। সর্ম্পকে তারা চাচাতো ভাই। ফোরকান মোল্লা জয়ঘোড়া সুফি নুর মোহাম্মাদ দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক। বাবুল মোল্লা পেশায় দিন মজুর। তার চার সন্তানের মধ্যে ২ মেয়ে ও ১ ছেলে বুদ্ধি ও বাক প্রতিবন্ধী। গত ২৮ ডিসেম্বর বিকেলে বাবুল মোল্লার ২৫ বছর বয়সি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হন। অভিযোগ উঠে ফোরকান ঘরে ডেকে নিয়ে ওই প্রতিবন্ধীকে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় ফোরকান মোল্লাকে আসামি করে থানায় মামলা করে ধর্ষণের শিকার তরুণীর ভাবী আইরিন বেগম। ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেন ফোরকান মোল্লা। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আলামত সিআইডির ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবরেটারিতে পাঠায় আদালত। এ ঘটনার পর গত দেড় মাস যাবৎ রামনগরের বাড়ি ছেড়ে নুরাইনপুর বাজারে ভাড়া বাসায় সপরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন ফোরকান মোল্লা। গত ৩১ মে গভীর রাতে তার রামনগরের খালি ঘরে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার ৫ দিন পর ৬ জুন পটুয়াখালী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘরে আগুন লাগানো ও চুরির অভিযোগ এনে মামলা করেন ফোরকান মোল্লা। মামলায় ধর্ষণের শিকার তরুণীর বাবা (প্রতিবন্ধী) বাবুল মোল্লা, মা শাহিনুর বেগম, ভাই (প্রতিবন্ধী) শাহ আলম মোল্লা, ধর্ষণ মামলার বাদি আইরিন বেগম ও স্থানীয় রিপন মোল্লা নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
ফোরকান মোল্লার ঘরে আগুনের ঘটনায় ধর্ষণের শিকার তরুণীর পরিবারকে আসামি করার খবরে এলাকাজুড়ে শুরু হয় আলোচনা- সমালোচনা। এলাকাবাসী ও ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের দাবি, ধর্ষণ মামলা থেকে বাচঁতে ঘরে আগুনের নাটক সাজিয়েছেন চতুর ফোরকান মোল্লা।
৩১ মে রাত দেড়টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রথম দেখতে পান একই বাড়ির মো. জহিরুল হক কাজল মোল্লা। তিনি বলেন, রাত দেড়টার দিকে ফোরকান মোল্লার ঘরের টিনের চালে আগুন দেখে ডাক-চিৎকার দিলে এলাকাবাসী চলে আসে। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
স্থানীয় প্রতিবেশী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. স্বপন মোল্লা, নিজাম উদ্দিন ও তোফায়েল হাওলাদার বলেন, যেদিন আগুনের ঘটনা ঘটে সেদিন ফোরকান মোল্লা এলাকায় ছিলেন। রাত ৯টার দিকেও ঘরে আসছেন। আগুন লাগার পর যখন তাকে ফোন করা হয় তখন তিনি বলেন, তিনি ঢাকাতে আছেন। কারও কাছে বলেন ধানদী রয়েছেন। তিনি আসতে পারবেন না। এমনও বলেছেন আগুনে সব পুড়ে যাক। যার ঘর সে যদি বলে পুড়ে যাক তাহলে বুঝা যায় সে নিজেই পরিকল্পতিভাবে আগুন দিয়ে অন্যকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
আরেক প্রতিবেশী মো. রিপন বলেন বলেন, ফোরকান মোল্লা এলাকায় একজন খারাপ লোক হিসেবে পরিচিত। তার চরিত্রও খারাপ। ধর্ষণের ঘটনার পর আমিসহ গ্রামের অনেক লোক ধর্ষণের শিকার তরুণীর পরিবারের পাশে দাড়িয়েছি। এই কারণে ষড়যন্ত্র করে ঘর পোড়ার মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে।
ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফোরকান মোল্লার দায়ের করা মামলা পাঁচজনকে স্বাক্ষী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩ নম্বর স্বাক্ষী মো. নুর ইসলাম। যদিও নুর ইসলাম জানেন না তাকে স্বাক্ষী করা হয়েছে। নুর ইসলাম বলেন, আগুনের খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে আসি। আগুন নিভানোর কাজে সহায়তা করি। তবে কারা আগুন দিয়েছেন তা আমি দেখিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী বাবুল, তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা আগুন নেভাতে সহায়তা করেন। পুকুর থেকে পানি আনতে ভাতের পাতিলও এগিয়ে দিয়েছেন। তাদের (প্রতিবন্ধী পরিবার) আগুন লাগাতে দেখিনি।
মামলার পাঁচ নম্বর স্বাক্ষী কাজী খলিলুর রহমান। তিনি থাকেন ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে নুরাইনপুর বাজারে। ঘটনার সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাথে ঘটনাস্থলে আসেন। কাজী খলিল বলেন, প্রতিবন্ধী পরিবার বা অন্য কারা আগুন দিয়েছে তা আমার দেখার কথা না। আমি থাকি নুরাইনপুর বাজারে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নুরাইনপুর বাজারে এসে ঘটনাস্থল চিনতে না পারায় আমি তাদের সাথে গিয়ে পথ দেখিয়ে দেই।
এই মামলার আরেক স্বাক্ষী বাদির খালাতো ভাই। তবে মামলার প্রথম দুই স্বাক্ষীকে নিয়ে এলাকা জুড়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাক্ষী আবুল বশার ও জুয়েল খলিফা বাদি ফোরকান মোল্লার ঘনিষ্টজন। প্রতিবন্ধী ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভুক্তভোগীর পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে ব্যর্থ হন তারা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী ধারণা করছেন, ওই ঘরে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানোর সাথে বশার ও জুয়েল সরাসরি জড়িত। আগুনের ঘটনার সময় তাদের চলাফেরাও ছিল সন্দেহজনক।
তবে এ বিষয়ে বশার ও জুয়েল বলেন, এলাকাবাসী তো কত কথাই বলে। সব তো সত্য নয়। স্বাক্ষী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘যা বলার আদালতে বলবো, আপনাকে (সাংবাদিক) বলব না।’
আগুনের ঘটনায় নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধির মা শহিনুর বলেন, ফোরকান আমার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নষ্ট করছে। এলাকায় বিচার পাইনি। তাই থানায় মামলা করছি। মামলা থেকে বাঁচতে নিজের ঘরে নিজে আগুন দিয়ে আমাদের ফাঁসাতে চাইছে।
ধর্ষণের শিকার মেয়ের বাবা প্রতিবন্ধী বাবুল মোল্লা স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। হাউমাউ করে শুধু বলছে, আমরা আগুন দেইনি, আগুন নিভাইছি।
আর ধর্ষণ মামলার বাদী আইরিন বলেন, আমার শ্বশুর, জামাই ও ধর্ষণের শিকার ননদ প্রতিবন্ধী। আমি ৮ মাসের অন্ত:সত্বা। নিজেরা ঠিকমতো চলতে পারি না। আরেকজনের ঘরে আগুন দিমু কিভাবে। ফোরকান মোল্লা ধর্ষণ মামলা থেকে বাঁচতে আগুনের নাটক সাজিয়ে আমাদের ফাঁসাতে চাইছে। যাতে আমরা ধর্ষণ মামলা তুলে ফেলি।
পরিকল্পিতভাবে নিজের ঘর পুড়িয়ে প্রতিবন্ধী পরিবারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন ফোরকান মোল্লা। তিনি বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দিয়েছে তারাই আমার ঘর পুড়িয়েছে। তাদেরকেই আসামি করেছি।
এ বিষয়ে বাউফল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এটিএম আরিচুল হক বলেন, ‘ঘরে আগুনের ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত বাদীর অভিযোগ মামলা হিসেবে রুজু করার নির্দেশ দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত না এমন কাউকে হয়রানি করবে না। প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।