এস এম সাইফুল ইসলাম কবির: বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা উপজেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় মানুষকে সুরক্ষা দিতে ‘টেকসই’বেরিবাঁধ নির্মাণ শুরু হয়েছে ২০১৫ সালে। ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পটিতে (সিইআইপি) অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার বাঁধের ৯৫ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে পুরোপুরি কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে হস্তান্তরের আগেই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় হওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে উপকূলের মানুষ। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, নদীশাসন প্রকল্প প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘৬২ কিলোমিটার বাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। বলেশ্বর নদের গভীরতা ও স্রোত বেশি থাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীশাসনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে ভাঙনের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাগেরহাটসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলা। এরপর থেকে শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জের মানুষের দাবি ছিল ‘টেকসই’ বেড়িবাঁধ। সে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার ‘টেকসই’ বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। তবে হস্তান্তরের আগেই শরণখোলা উপজেলার বগী, গাবতলা, মোরেলগঞ্জের আমতলা, ফাসিয়াতলা থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রায় ৭০০ মিটার বাঁধের ব্লক ধসে বিলীন হচ্ছে বলেশ্বর নদে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অন্তত ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।
শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বলেশ্বর নদের ভাঙনে আমরা প্রায় ১৫০ বিঘা জমি হারিয়েছি। সিডরে স্বজন হারিয়েছি। বাঁধ নির্মাণ শুরু হলে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। মনে করেছিলাম ভাঙন ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাব। সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। “টেকসই” বাঁধেই ভাঙন শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে বড় ধরনের ভাঙন শুরু হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে বিপুল অর্থের এ বাঁধ আমাদের কোনো কাজে আসবে না।’
গাবতলা এলাকার আব্দুর রশীদ বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণের শুরুতেই আমরা নদীশাসনের দাবি করেছিলাম। এজন্য সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছিলাম। তার পরও নদীশাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করেছে। এখন বাঁধে ভাঙন শুরু হয়েছে। আমাদের ফসলি জমি, গাছপালা, বসতঘর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’
বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তুলে দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের জামাল জমাদ্দার বলেন, ‘বাঁধের দুই পাশে মাটি দিয়ে মাঝখানে ১০-১২ ফুট উচ্চতায় বালি দেয়া হয়েছে। যেকোনো সময় ব্লক সরে গেলে, সব বালি নদে বিলীন হয়ে যাবে। তখন কয়েক কোটি টাকার এ বাঁধ কোনো কাজেই আসবে না।’
ফসিয়াতলা এলাকার দেলোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিনিয়তই ভাঙনে ধসে পড়ছে ‘টেকসই’ বাঁধের ব্লকগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করলেও কোনো কাজে আসছে না। নদে পানির গভীরতা ৫০-৬০ হাতের ওপর। সরকারের কোটি কোটি টাকা জলেই যাচ্ছে।’
ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলে কোনো কাজে আসছে না বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারের প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গাবতলায় ভাঙন রোধে ২০০ মিটার এলাকায় ১৪ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তার পরও ভাঙন রোধ হচ্ছে না। এখানে কংক্রিটের ব্লক ফেলানো জরুরি।’
শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, ‘প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতায় বাঁধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে। নদীশাসন না করেই বাঁধ নির্মাণের ফলে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন ও ফাটল দেখা দিয়েছে।’ শিগগিরই নদী শাসন করে বাঁধটি ‘টেকসই’ করার দাবি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে সিইআইপি প্রকল্পের মাঠ প্রকৌশলী মো. রাকিবুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘বাঁধের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে হস্তান্তরের কথা। তবে বলেশ্বর নদের স্রোত তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে নদীশাসন জরুরি।