সৌদি আরবে তাবলীগ নিষিদ্ধ হলো কেন, এর প্রভাব কী?

তাবলীগ জামাত ইসলামের পাঠ দেয়ার নামে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করছে এমন অভিযোগ করে তাদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখা যাবে না বলে সতর্ক করে তাবলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব।

একই সঙ্গে দাওয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একই ফতোয়া জারি করা হয়েছে। এক টুইটে দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সৌদি আরবে তাবলীগ ও ‘দাওয়াহ’ গ্রুপ অর্থাৎ ধর্মপ্রচারের পক্ষপাতমূলক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সৌদি আরবের ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তাবলীগ জামাতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। শুক্রবার নামাজের জামাতে এ বিষয়ে সমস্ত মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রতিটি মসজিদকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত
সৌদি আরব এখন তাবলীগ নিষিদ্ধ করলেও এর প্রেক্ষাপট অনেক পুরনো। একশ বছর আগে ভারতে প্রথম তৈরি হয়েছিল তাবলীগ জামাত। মহম্মদ ইলিয়াস কান্দলাবি যখন তাবলিগ তৈরি করেছিলেন, তখনও এদের নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। ইলিয়াসের বক্তব্য ছিল, বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কাজ করবে সংগঠনটি। বস্তুত, এখনো গ্রামে গ্রামে ঘুরে সে কাজই করে তাবলিগ। কীভাবে আদর্শ মুসলিম হয়ে উঠতে হবে, তার পাঠ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে সৌদি আরবে ওয়াহাবি মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওয়াহাবিদের সঙ্গে তাবলীগের বরাবরই বিরোধ ছিল। সৌদিতে ওয়াহাবিদের গুরুত্ব বেশি। তাদেরই চাপে সরকার তাবলিগকে নিষিদ্ধ করতে পারে। অবশ্য ভারতে তাবলীগ নিয়ে যখন বিতর্ক হয়েছিল তখন ওয়াহাবিরা তাবলীগের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

তবে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনা করে অনেক আগে থেকেই সৌদি আরবে প্রকাশ্যে তাবলিগের কোনো কার্যক্রম ছিল না। ২০১৬ সালে সৌদি আরবের তৎকালীন গ্র্যান্ড মুফতি আবদ-আল-আজিজ ইবনে বাজ তাবলিগ জামায়াতের বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি করেন। তাদের অভিযোগ, ‘ফাজায়েলে আমল’ তাদের মূল গ্রন্থ। কোরআন ও সহি হাদিসের গ্রন্থের চেয়ে তাবলীগিরা এই গ্রন্থটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ধারণা করা হচ্ছে, আরও কিছু দেশের সরকারও সৌদি আরবকে অনুসরণ করে তাবলিগকে নিষিদ্ধ করতে পারে।

এছাড়া সৌদি আরবে ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভিন্ন পথে হাঁটছে দেশটি। সিনেমা হল খুলে দেয়া সহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড দেখা যাচ্ছে সেখানে। সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেও তাবলীগ জামাত নিষিদ্ধ হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

তাবলীগ নিষিদ্ধের প্রভাব কী হতে পারে
সৌদি আরবে তাবলীগের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা সংগঠনটির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তারা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাবলীগের প্রভাব যথেষ্ট। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাবলিগের শক্তিশালী সংগঠন আছে। কিন্তু তাবলিগের মূল টাকা আসে আরব থেকে। ফলে সৌদিতে তাবলীগ নিষিদ্ধ হলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তাদের টাকায় টান পড়বে এবং সংগঠনটির স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। এছাড়া সৌদির পন্থা অনুসরণ করে অন্যান্য দেশও তাবলীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।

এমন শঙ্কা থেকেই সৌদি আরবের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের দেওবন্দি আলেমরা এর তীব্র সমালোচনা করছেন। এদেরই একজন ভারতের দেওবন্দি আলেম শায়খ সালমান হুসাইনি নদভি। তিনি বলেন, বর্তমান সৌদি সরকার যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্ট হয়ে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে কাজ করছে, এমন নির্দেশনায় সেটি আরও স্পষ্ট হলো।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিস মোশাওয়ারাতের প্রধান নাভেদ হামিদ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সৌদির বিবৃতিটি এখনো খুব স্পষ্ট নয়। তারা তাবলীগের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, নাকি স্থানীয় স্তরে কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে, এ বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে না। যার থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ওয়াহাবিদের সঙ্গে তাবলীগের ইসলামিক ভাবনার তফাত আছে। কিন্তু তাই বলে একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হবে কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে এর প্রভাব ভারতে পড়বে বলে মনে হয় না।

তাবলীগকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন জিয়া উস সালাম। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মতো কোনো কাজ তাবলিগ করে না। তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসের যোগ তৈরি করা অনুচিত। সৌদির মতো রাষ্ট্র এ কাজ করলে অবাক লাগে।’

বাংলাদেশের আলেম মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভি বলেন, সৌদি সরকার শতবর্ষী একটি দিনি আন্দোলনকে এভাবে একতরফা নিন্দা ও নিরুত্সাহিত করতে পারেন না। এ বিষয়ে মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে হাসানি নদভি, মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি, মাওলানা মুফতি তাকি উসমানিসহ বিশ্বের সেরা আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। কেননা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ এখনও এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি!

বাংলাদেশেও কি নিষিদ্ধ হতে পারে তাবলীগ জামাত?
তাবলীগ জামাত কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে দলমত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এর প্রতিফলন মসজিদে দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদেরকে নানা ধরনের সহযোগিতাও করে থাকেন সাধারণ মানুষ। সেই হিসাবে তাবলীগ জামাত এখানে খুবই জনপ্রিয়।

তবে সেই জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই হারিয়েছে তাবলীগ জামাত নিয়ে সংগঠনটির একাধিক গ্রুপের রেষারেষিতে। বিশ্ব ইজতেমা থেকে এর শুরু। এবারও মাওলানা সাদপন্থী বা নানা পন্থী হলে এখানেও তাবলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার শঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ শঙ্কা থেকেই হেফাজতে ইসলাম সহ দেওবন্দ পন্থী কওমি আলেমরা সৌদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এমনকি হেফাজতে ইসলাম সহ কওমিপন্থী নানা ব্যক্তি ও সংগঠন এ বিষয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন।