রোহিঙ্গা ইস্যু এখন যদিও নিত্য আলোচনার বিষয়, তবুও গত কয়েকদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়িয়ে এক ডাকাতের নাম জাতীয়ভাবে আলোচিত হচ্ছে। ওই রোহিঙ্গা ডাকাতের নাম নূর মোহাম্মদ। শুরুতে সে তার মেয়ের ‘কান ফোঁড়ানো’র নামে রাজকীয় আয়োজন করে আলোচনায় আসলেও স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডে তার নাম থাকায় সমালোচিত হতে থাকে।
রোববার ভোরে অবশ্য এই ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা ডাকাতের চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়েছে। যুবলীগ নেতা ওমর হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর মোহাম্মদ কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এখানেও সেই চিরাচরিত স্ক্রিপ্টের অবতারণা হয়েছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ গণমাধ্যমকে বলেছেন: আলোচিত রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদকে শনিবার গ্রেপ্তারের পর রোববার ভোররাতে টেকনাফ থানার ওসি তদন্ত এবিএম দোহার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তার দেয়া তথ্যমতে তাকে সাথে নিয়ে টেকনাফ উপজেলার নীলা জাদিমুরা ২৭ নম্বর ক্যাম্পের পাহাড়ী জনপদের বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র ভান্ডার উদ্ধার করতে যায়, সেখানে গেলে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থি সংগঠন এবং মাদক কারবারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশও পাল্টা গুলি শুরু করে।
এসময় টেকনাফ থানার ওসি তদন্ত এবিএম দুহা, কনস্টেবল আশেদূল ও কনস্টেবল অন্তর চৌধুরী আহত হন বলেও জানিয়েছেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
তিনি বলেন: এসময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪টি এলজি, ১টি থ্রি কোয়াটার, ১৮ রাউন্ড গুলি ২০টি ঊষাসহ গুলিবিদ্ধ নূর মোহাম্মদকে উদ্ধার করে। এসময় নূর মোহাম্মদকে টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই বন্দুকযুদ্ধ বিতর্কিত হলেও শঙ্কার বিষয় অন্য জায়গায়। নূর মোহাম্মদ মিয়ানমারের নাগরিক হলেও তার কাছে বাংলাদেশের স্মার্টকার্ড পাওয়া গেছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ ওরফে নুর আলম মিয়ানমারের আকিয়াব এলাকার কালা মিয়ার ছেলে। সে বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফের ২৭ নম্বর শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছিল। তবে এদেশে তার ৪টি বাড়ি রয়েছে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকরা মানবিকতার খাতিরে এখানে সাময়িক আশ্রয় পেলেও এদেশের নাগরিকত্ব অর্থাৎ স্মার্টকার্ড কিভাবে পায়? নূর মোহাম্মদের মতো একজন চিহ্নিত অপরাধী যদি স্মার্টকার্ড পায়, তাহলে সেখানকার অন্য রোহিঙ্গাদের অবস্থা কী, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠার কথা। অন্যদের কথা বাদ দিলেও নূর মোহাম্মদ যে তার সাঙ্গ পাঙ্গদের স্মার্টকার্ড পাইয়ে দেয়নি তার নিশ্চয়তা কী?
রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় পরিচয়পত্র তো দূরের কথা, জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমই বন্ধ ছিল। শরণার্থী হিসেবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে রোহিঙ্গারা যাতে এদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র না পায় এজন্যই মূলত এই কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এরপরও এমন অপরাধ বন্ধ করা যায়নি। তারা পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন সনদ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। কয়েকদিন আগেও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে বাংলাদেশি বানানোর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
এসব বিষয় জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কতোটা হুমকি তা রোহিঙ্গা ঢলের ২ বছর উপলক্ষে তাদের বিশাল সমাবেশের দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লাখো রোহিঙ্গার ওই সমাবেশে প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল। অথচ এই রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইলের সিম পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু লাখ লাখ রোহিঙ্গা তা পেয়েছে। কিভাবে তারা সিম পেল? গত কয়েকদিন এই প্রশ্ন থাকলেও নূর মোহাম্মদের স্মার্টকার্ড পাওয়ার খবরে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা যদি এভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড পায় তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কতোটা হুমকি তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
এসব বিষয় যে সরকারের জন্যও চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে তা উঠে এসেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। তিনি বলেছেন: এত বড় শোডাউন হলো, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হলো। কারও জাতীয় আইডি নাই, কিন্তু সবার হাতে সেলফোন আসল কোত্থেকে?
শুরু থেকেই এসব কর্মকাণ্ডের সাথে কিছু এনজিও সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের সাথে স্থানীয় কতিপয় অসাধু ব্যক্তি জড়িত। এমন অপকর্মে লিপ্ত থাকায় ইতোমধ্যে কক্সবাজার থেকে ৪১টি এনজিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া তাদেরকে পাসপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং এদেশে দালালচক্র জড়িত।
গত জুলাই মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন: দূতাবাসের কিছু অসাধু ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রদানে সাহায্য করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্সে রয়েছে। তাই অসাধু কোন কর্মকর্তাকে ছাড় দেয়া হবে না। সরকারের এই অবস্থান সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য হলেও শেষ পর্যন্ত তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে যাওয়ার সময় রোহিঙ্গাদের আটক করা হয়েছে। কিন্তু এই অপরাধ নির্মূলে এসব পদক্ষেপ যথাযথ নয়। তাই এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এভাবে যদি রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড বা পাসপোর্ট পেতে থাকে তাহলে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। দীর্ঘমেয়াদে এর খেসারত বাংলাদেশকেই দিতে হবে। যেমন বাংলাদেশের স্মার্টকার্ড পাওয়া রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ খুন করেছে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে। সরকারদলীয় নেতারাও যখন আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না, সেখানে স্থানীয় সাধারণ মানুষ কতোটা অসহায় তা সহজেই বুঝা যায়।
এছাড়া সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি সংবাদমাধ্যমের বাংলা বিভাগের এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ভয়াবহ দিক তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে: বাইরের দিক থেকে এই শরণার্থী ক্যাম্প আপাতত শান্ত মনে হলেও ভেতরে-ভেতরে অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পের ভেতরে দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতের বেলায় চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। রাতের আঁধার নামার সাথে সাথেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়: এমন অনেক জায়গা আছে যেকানে পৌঁছাতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। ফলে যে কোন অপরাধ করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রাতের বেলায় এসব জায়গায় যেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ বোধ করেন না।
এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সশস্ত্র গ্রুপের তৎপরতা এবং খুনের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে এমন আশঙ্কার কথা বলে আসলেও তখন ‘মুসলিম’ পরিচয়ের কারণে এখানকার অনেকেই তাদেরকে আশ্রয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। যাহোক, মানবতার খাতিরে তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হলেও ক্যাম্পগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো দরকার।
কারণ, পর্যাপ্ত গোয়েন্দা নজরদারির অভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পিলখানা ট্র্যাজেডির মতো বড় কলঙ্কের ইতিহাসও আমাদের আছে। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দেশি-বিদেশি অপশক্তি তো আরও বেশি তৎপর। অথচ রোহিঙ্গারা এত বড় সমাবেশ করলো তা নাকি সরকারের জানা ছিল না! এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়কে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু এতকিছুর পরও এসব বিষয় দেখার যেন কেউ নেই। এমন গা ছাড়া ভাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা রোহিঙ্গােদের জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড ও পাসপোর্ট দেয়ার মতো অপরাধের সাথে জড়িত তাদেরকে শুধু নিষিদ্ধ করা নয়, বরং দৃষ্টান্তমূলক ও কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)