যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন না শামীমা বেগম: সুপ্রিম কোর্ট

18

বিবিসি”র প্রতিবেদন

সম্পাদনা:জিয়াউদ্দীন চৌ: ( জেড সেলিম )

জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এ যোগ দেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শামীমা বেগম সিরিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে রায় দিয়েছে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট।রায়ে আদালত জানিয়েছেন, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে তাকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে দেওয়া ঠিক হবে না ।শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দেশটির সর্বোচ্চ আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্ত আইনগতভাবে মোকাবিলায় ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণী।

বর্তমানে ২১ বছর বয়স্ক শামীমা বেগম তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তরাজ্যে ফিরতে চেয়েছিলেন।কিন্তু এক সর্বসম্মত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে,তাকে ব্রিটেনে ফিরতে না দিয়ে সরকার শামীমা বেগমের অধিকার লংঘন করেনি।তিনি এখন উত্তর সিরিয়ায় সশস্ত্র রক্ষীর প্রহরাধীন একটি শিবিরে বাস করছেন।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শামীমা বেগম ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব লন্ডনের আরো দুজন স্কুলপড়ুয়া মেয়েসহ যুক্তরাজ্য ত্যাগ করে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া চলে যান, এবং ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর সাথে যোগ দেন।তখন শামীমা বেগমের বয়স ছিল ১৫। সেখানে তিনি একজন ডাচ জিহাদিকে বিয়ে করেন ।দু বছর আগে ব্রিটেনের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে তার নাগরিকত্ব বাতিল করেন।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশী অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন এলাকা থেকে দুই বান্ধবী খাদিজা সুলতানা ও আমিরা আবাসি-সহ আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা বেগম।সিরিয়ায় গিয়ে এই তরুণী নেদারল্যান্ডস থেকে আসা একজন আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেছিলেন।তাদের তিনটি সন্তান হয় – কিন্তু তাদের সবারই অল্প বয়সে মৃত্যু হয়।২০১৯ সালের প্রথম দিকে লন্ডনের দৈনিক দি টাইমসের একজন সাংবাদিক সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে শামীমা বেগমের খোঁজ পান।ঐ সাংবাদিকের মাধ্যমে শামীমা বেগম ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যে তাকে যেন ব্রিটেনে ফেরত আসতে দেওয়া হয়।সে অনুমতি না দিয়ে সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।সেসময় শামীমা বেগমের মা বাংলাদেশী – এ কারণে তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় চাইতে পারেন এমন কথা বলা হয়েছিল।কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছিলেন,শামীমা বেগম কখনোই বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন না এবং তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না।

শামীমা বেগম কি ঘটনার শিকার?

ফিনান্সিয়াল টাইমসে এক নিবন্ধে এই প্রশ্ন তুলেছেন হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ক্যামিলা ক্যাভেন্ডিশ। অনেকে তাই-ই মনে করেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল রিচার্ড ড্যানাট স্কাই নিউজকে বলেন, অন্যদের চরমপন্থী হওয়া থেকে ঠেকাতে যুক্তরাজ্যের উচিত তাকে “অল্পস্বল্প অনুকম্পা” দেখানো।

তিনি বলেন, “সে যদি এখানে ফিরে আসতে না পারে, তাহলে সে কোথায় যাবে? জীবনের বাকী দিনগুলো তো সে আর একটি শরণার্থী শিবিরে কাটাতে পারে না।”বিবিসির সাবেক একজন প্রেজেন্টার রবিন লাসটিগ তার বিষয়টিকে ‘সহানুভূতি’র সঙ্গে দেখার জন্য বলেছেন। তাঁর মতে, শামীমা ছোটবেলায় হয়তো ঠিকমতো বেড়ে ওঠেননি।

তিনটি স্কুলবালিকা যখন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল,তখন তাদেরকে “ঝুঁকি নয় বরং অনেকটা পথহারা” বলেই মনে করা হয়েছিল – বলছিলেন মিজ ক্যাভেন্ডিশ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রথম দিকে যারা আইএস থেকে ফিরে এসেছেন,তাদের একটা বড় অংশকেই এখন আর জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না।

তবে মিজ ক্যাভেন্ডিশ বলেন,দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা “ব্যতিক্রম”।”যারা যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যন্ত ছিলেন, তারা অনেক শক্ত। তারা ভালোভাবে পিছনের চিহ্ন মুছে ফেলেছেন।”

ব্রিটেনের বিদেশ বিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স-এর প্রধান অ্যালেক্স ইয়ঙ্গার টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রকে বলেন, আইএস-এর হয়ে যুদ্ধ করেছেন কিংবা সমর্থন করেছেন, এমন ব্রিটিশ নাগরিকদের নিয়ে তিনি “দারুণ উদ্বিগ্ন”।

তিনি বলেন, “অভিজ্ঞতা আমাদের বলছে যে একবার কেউ ওই পথে গেলে তিনি এমন সব কৌশল রপ্ত করেন আর যোগাযোগ গড়ে তোলেন, যা তাকে সম্ভাব্য বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে রূপান্তরিত করে।”মিজ ক্যাভেন্ডিশ বলেন, শামীমা বেগম যদি এমনকি কোন অপরাধ করেও থাকেন, হয়তো সে ব্যাপারে খুবই অপ্রতুল প্রমাণ পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে শামীমা বেগম যেমনভাবে বিবিসিকে বলেছেন – “আমি সেখানে গেলাম,একজন গৃহবধূ হিসেবে বাড়িতে বসে রইলাম, তারা আমার যত্ন নিলো – এগুলো আসলে ঠিক তাদেরকে সাহায্য করা নয়।আমি তাদের বুলেটের খরচ যোগাইনি, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যও আমি কোন পয়সা দেইনি।”

অনুশোচনা নেই

যা তিনি করেছেন, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত শামীমা বেগম খুব কমই অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। তিনি এমনকি এমনও বলেছেন যে ময়লার ঝুড়িতে রাখা মানুষের কাটা মাথা দেখেও তার কোন ভাবান্তর হয়নি।বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, “যুদ্ধের ভিডিও” – যার মধ্যে ছিলো শিরোশ্ছেদের মতো ঘটনা – দেখে তিনি আইএস-এ যোগ দিতে অংশত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আর ছিল পরিবারগুলোকে আইএস-এর দেয়া “চমৎকার জীবন”-এর ভিডিও।

মধ্যপ্রাচ্যে বিবিসির সংবাদদাতা কোয়েন্টিন সামারভিল বলছেন যে “সাক্ষাৎকারের পুরোটা সময় শামীমা বেগম ইসলামিক স্টেটের দর্শনের পক্ষাবলম্বন করে গেছেন”।তিনি আরও বলেন, “আইএস-এর দ্বারা ইয়াজিদী নারীদের দাসত্ব, হত্যা ও ধর্ষণের বিষয়ে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তার উত্তর ছিল ‘শিয়ারাও ইরাকে একই কাজ করেছিল’।

আইএস যে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে, ২০১৭ সালের ম্যানচেস্টার অ্যারেনায়, সেই হামলায় ২২ জনের মৃত্যুর বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে শামীমা বেগম উত্তর দেন যে তিনি মনে করেন “নিরাপরাধ মানুষ মারার বিষয়টি ভুল”।কিন্তু এও মনে করেন যে ওই ঘটনা ছিল “আইএস এলাকায় নারী ও শিশুদের হত্যার ঘটনার” এক ধরণের “প্রতিশোধ”।

নৈতিক টানাপোড়েন

ব্রিটিশ সরকার আগে থেকেই কঠিন এক আইনগত টানাপোড়নের মধ্যে ছিল। শামীমা বেগম জনসমক্ষে চলে আসার ঘটনা এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য আরেকটি নৈতিক উপাদান যোগ করলো।আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যে কোন ব্রিটিশ নাগরিককে যুক্তরাজ্য দেশে ফিরতে দিতে বাধ্য, যদি না তিনি অন্য দেশের নাগরিকত্ব দাবি করেন।

কিন্তু ব্রিটেনের কোন কনস্যুলেট সিরিয়ায় নেই।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেছেন একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে যোগদানকারী কোন ব্রিটিশ নাগরিককে সাহায্য করতে গিয়ে দেশটি অন্য কাউকে বিপদে ফেলবে না।

শামীমা বেগম যদি কোনভাবে একটি ব্রিটিশ কনস্যুলারে পৌঁছুতেও পারেন, তাহলে খুব সম্ভবত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তাকে তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে এবং ফিরে এলে হয়তো তার বিচারও হবে – যদিও এটা পরিস্কার নয় যে ঠিক কোন অভিযোগে এই বিচার হবে।

মি. জাভিদ বলেন, তিনি ১৩৫১ সালে প্রণীত একটি আইন সংশোধনের বিষয় বিবেচনা করছেন যাতে করে “যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত কিংবা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করায় অভিযুক্ত, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়”।

পোস্টার গার্ল

শামীমা বেগম বলেছেন যে ব্রিটেনে যদি তাকে শিশু সন্তানসহ ফিরতে দেয়া হয়, তাহলে তিনি জেলে যেতেও রাজি।চার বছর আগে তিনি যখন দেশ ছাড়েন, তখন তিনি আলোচনায় ছিলেন।আজ আবারও তিনি আলোচনায়।

কিন্তু তিনি বলেছেন যে তিনি কখনোই ইসলামিক স্টেটের “পোস্টার গার্ল” হতে চাননি, চাননি তার কর্মকাণ্ডকে গোষ্ঠীটির জন্য “প্রপাগান্ডা বিজয়” হিসেবে দেখা হোক।বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমি তো নিজেকে খবরে নিয়ে আসিনি”। “পোস্টার গার্লের বিষয়টা আমার পছন্দেও ঘটেনি”।