অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, সংস্কার নিয়ে বৃহত্তর ঐকমত্যে পৌঁছাতে তার সরকার চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি রাজনৈতিক দল ও সমাজের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক বৃহত্তর সংলাপ শুরু করবে। নির্ধারিত সময়ে (এ বছরের শেষের দিকে অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
গত ২৯ ডিসেম্বর নিউ এজকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা জানান। সাক্ষাৎকারটি আজ শনিবার প্রকাশিত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের চার মাস পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কোন পর্বটা ভালো বা খারাপ লেগেছে—এমন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলবো না। তবে এটা ভিন্ন, আগে ছিলো আমার নিজস্ব জগত, সারাজীবন ধরে যা যা করে আসছি তার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মতো করে আমি ট্যাকেল করেছি। আমার উত্তরগুলো দিয়েছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারেই আমার নিজস্ব জগত। এটা একটা ভিন্ন জগত। এটা আমার নিজস্ব জগত না। এই জগতে আমি কোনোদিন ছিলাম না। থাকার কোনো আগ্রহও ছিলো না। এটার ডান-বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কাজেই ভিন্ন জগত। কিন্তু এটা একটা চ্যালেঞ্জ আছে। আমাকে আহ্বান জানিয়েছে, তবে প্রথমে একটু সংকোচ করছিলাম যে যাওয়া ঠিক হবে না। যেহেতু আমি এই জগতের মানুষ নই। তারা আমাকে পার্সুয়েট করেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছি। এইভাবে তোমরা প্রাণ দিয়েছো, রক্ত দিয়েছো। আমার জন্য না হয় একটু চ্যালেঞ্জিং হলো। তাহলে আমি যাই। সেভাবেই আমি রাজি হলাম। কাজেই ভিন্ন জগতের মধ্যে চলছি। দেখা যাক কতদূর যেতে পারি।
আগস্টের ৮ তারিখ এই জগতটা যদি আপনার জন্য শুরু না হতো, তার পেছনের যে ৪ মাস। মনে হয় ততদিনে আপনার জেলে থাকার কথা ছিলো? এই প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, হয়ত, তখন আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাবো। বাংলাদেশে যাতে ফিরে যেতে না হয়। একটি উপলক্ষে আমি আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছি ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেলাম। কারফিউ দেখে গেলাম। এর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। কাজেই উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। কারফিউ ভেঙেই গেলাম, না হলে যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস পথে কেউ ধরেনি। তবে অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিলো না। এমন অবস্থা দেখে গেছি, ক্রমাগতভাবে এটা দেখছি। পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখছি। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডিংটা পাচ্ছিলাম। তারমধ্যেই এই ঘটনা ঘটলো। এটা অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। তখনো বুঝিনি এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। এরমধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।
৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলো কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। মানুষের এমন কি ভাবনার সুযোগ আছে যে, আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে সেখানে এই রকম ঘটনা ঘটেছে—জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি বলবো এটা সরকারে থাকি বা দেশে না থাকি, এগুলো এমনি চলে যেতো। কাজেই কোনো ভিত্তি নেই। যারা আদালতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। তারাই এটা বোঝাতে পারতেন যে, এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার প্রশ্ন নেই, তথ্য নেই। কাজেই এটা খুবই ঠুনকো জিনিস। এটা জানা-অজানার কোনো বিষয় না। যেহেতু এটা বিচারের বিষয় বিচারেই চলে যেতো। কাজেই আমি থাকলেও যেতো, না থাকলেও যেতো। ঘটনাচক্রে আমি ছিলাম।
বিচারব্যবস্থার ওপর তৎকালীন সরকারের যে প্রভাবের কথা মানুষ বলছিলো। বা বলাবলি আছে এখনো। আপনি কি মনে করেন ওনারা ক্ষমতায় থাকলেও কোর্ট ওভাবে ব্যবহার করতো? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, আগে যারা ছিলো তারা তো করেনি। আর করেনি বলেই তো আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। এখন যারা এসেছে তারা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।
তখন যেভাবে চলছিল, তাহলে তো জেলে যাওয়ার কথা ছিল—প্রশ্নে তিনি আরো বলেন, তখন তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। প্রতিবারেই মনে হচ্ছে এবারই মনে হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি এবার ফেরা নাও হতে পারে। আমার সহযোগী যারা আছেন, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনকে বলে গেছেন। আমি বলেছি- আমার কিছু করার নেই। যা নিয়তি আছে হবে, আমি আমার পরিবারকেও প্রস্তুত করিনি। রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি সহজভাবে নিচ্ছিলাম। এটা নিয়তির খেলা। সুতরাং প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নেই।
২০০৭ সালে যখন আপনি একটা দল করতে গিয়েছিলেন। এটা তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেটা যদি আপনি চালিয়ে যেতেন, তাহলে তো আপনাকে রাজনৈতিক দায়িত্বই পালন করতে হতো—সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, সেটার কারণ ছিল, রাজনৈতিক দলতো ছিলো না আমার। আমার বন্ধু-বান্ধব বলতো আপনি একটা দল করেন। এভাবে পেছনে লেগে রইলো। আপনি ছাড়া পারবে না কেউ। আশপাশের লোকজন যা যা বলে আরকি। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই শেষে বললাম আমি করবো দল। সাংবাদিকরা ধরলো, তখন আমি বললাম হ্যাঁ আমি দল গঠন করবো। তখন বিভিন্ন জায়গায় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম। উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার এয়ারপোর্টেই এ কথাগুলো হচ্ছিলো। আর কোথাও না। একসময় ধরলো-তাহলে কী নাম দেবেন? আমি বললাম নাম ঠিক করিনি। করলে আপনাদের জানাবো। তখন একটা নাম দিলাম। সেটা হলো নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম বিষয়টা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তখন সবাইকে বললাম, মতামত নাও। কোনোভাবে এটা থেকে দূরে সরে যাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করছিলাম। নামও হলো মতামতও হলো। তারপর দেখলাম এর মধ্যে বেশি ঢুকে যাচ্ছি। তখন আমি বললাম না আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না। তখন রাজনীতির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এসব আমার মাথায় ছিলো না। পরিকল্পনা ছিলো না, এটা দীর্ঘমেয়াদী জিনিস।
তিনি আরো বলেন, আমি তখন রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেওয়ার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। সবাই ধাক্কা দিচ্ছে আপনাকে করতে হবে। শেষে মনে করলাম এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন পরিষ্কার বলে দিলাম। সবাই হতবাক হয়ে গেলো। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম।
ঐ নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের জাতীয় নাগরিক কমিটির চিন্তার বা ভাবনার কোনো সম্পর্ক আছে—জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নাগরিক শব্দটা কমন আছে। তাছাড়া আমার সঙ্গে তাদের কোনো আলোচনা হয়নি। তারা শব্দটা কোথায় পেলো।
তিনি বলেন, নাগরিক শব্দটা যেকোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারে। আমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ হয়নি।
সম্প্রতি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছেন সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি ও নির্বাচন। এই দুটোকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে—প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, না, এখনো সাংঘর্ষিক পর্যায়ে যায়নি। একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম। প্রক্রিয়া হলো, কতগুলো কমিশন গঠন করেছি। একেকটা বিষয়ের ওপর কমিশন গঠন করেছি। এই রকম ১৫টি কমিশন করেছি। তারমধ্যে ৬টি কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ৯০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিলো। তারা নব্বই দিনের মধ্যে শেষ করতে পারেনি। তারা বলেছে ১ সপ্তাহ দেরি হতে পারে। কারণ আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, প্রথমে তাদের বসার জায়গা দিতে পারিনি। কাজেই ঠিক নব্বই দিন সময় তারা পায়নি। ৬টা কমিশন যদি ৭ জানুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দেয়, তাহলে আমরা পাবো। ওখানে সংস্কার বিষয়ক সব বিষয় দেওয়া থাকবে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে। তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে আবার কোনোটা টেকেনি। তারপর কমিশন মনে করেছে এটাই আমাদের সারমর্ম। তখন বৃহত্তর সংলাপের জন্য এগুলো নিয়ে আসবে। সেদিন একটা সংলাপ হয়েও গেলো। যদিও এখনো রিপোর্ট আসেনি। সবাইকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ। সেদিন একটা কমিশন ঘোষণা করলাম। এই কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন, যেটার বাইরে থেকে আমি নিজে চেয়ারম্যান হলাম। সেখানে প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করলাম।
তরুণরা দল করবে। তারা কনস্টিটিউনসি বিল্ডআপ করবে। এই কারণে তাদের সময় দরকার। তারা নিশ্চয়ই সংস্কার চান। ক্ষমতার রাজনীতিতে এই মুহূর্তে তারা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করার। এই কারণে অন্যরা মনে করে শুধু অন্য একটি গ্রুপকে সময় দিতে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না—প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, সেজন্যই ঘোষণা দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম। যাতে সন্দেহ না থাকে। যতকিছুই টানতে চান না কেন, আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওখানে হবে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে, আরো সুনির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষণা করতে—প্রশ্নে ড. ইউনূস আরো বলেন, এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, তারা বাড়াতে চাচ্ছেন না। কোন তারিখে হবে। ঐ প্রসেসটা অগ্রসর হলেই আমরা দেখবো। আমরা তো বাঁধ দিয়ে দিলাম। এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না। এটা হলে এই পর্যন্ত, ওটা হলে ঐ পর্যন্ত। তবুও কথাটা বারবার বলছেন।
তিনি আরো বলেন, আমরাও চাই চাপের মধ্যে থাকি। আমাদের ভেতরেও তো নানা মত থাকতে পারে। সেজন্যই বাঁধ দেওয়া হলো যে, এই পর্যন্তই। এর ভেতর থেকেই আমারদের যা কিছু করতে হবে। যাতে কেউ বলতে না যে, সংস্কার করতে ৫ বছর সময় লাগবে। যা কিছু হবে এরমধ্যেই করতে হবে। সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার, দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে, আরো ছয় মাস বাড়াতে, বললাম-না এর ভেতরেই করতে হবে। এই যে একটা বাঁধ দেয়া, এটা আমাদের জন্য খুবই দরকারি। এর মধ্যেই যাতে আমরা সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।