মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সরানোর পর মন্ত্রণালয় থেকেও রাজাকারের তালিকার মূল নথি গায়েব হয়ে গেছে। রাজাকারদের আলোচিত তালিকা সরানোর জন্য সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে দায়ী করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবদুল লতিফ মির্জাসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতার নাম থাকায় মোজাম্মেল হকের ওপর ঐ সরকারের প্রচণ্ড চাপ ছিল।
তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য গোলাম আরিফ টিপু আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পৃথকভাবে আবেদনও করেছিলেন। বিগত সরকার গোটা তালিকাই গায়েব করে দিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
যে তালিকা নিয়ে চাঞ্চল্য
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশনেও প্রস্তাব পাস হয়। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সারাদেশ থেকে রাজাকারদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।
২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ উপলক্ষে সরকার একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। দেশ-বিদেশের বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেন।
প্রকাশিত এ তালিকাটি গণমাধ্যমে দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশিত এ তালিকায় বিএনপি কিংবা ইসলামপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর নাম ছিল না। সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা হয়। জবাবে মন্ত্রী বলেন, তালিকাটি প্রকাশের আগে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করেছি। তাদের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রাজাকার হিসেবে যাদের নাম এসেছে এখানে শুধু তাদের নামই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রাজাকারের এ তালিকায় রাজাকারদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু এবং সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতাসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অন্তত ১ হাজার ব্যক্তির নাম ছিল। এ তালিকা প্রকাশের পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টির হয়।
নাম বাদ দিতে তিন মন্ত্রণালয়ে আবেদন গোলাম আরিফের
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিব্রতবোধ করেন গোলাম আরিফ টিপু। তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার জন্য তিনি আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন।
তালিকা প্রকাশের তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বিব্রতবোধের কথা সাংবাদিকদের জানান গোলাম আরিফ টিপু। তিনি বলেন, বুঝে পেলাম না কোথা থেকে এই শক্তিটা তারা পেলেন। মনে হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের অশুভ বা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির অবস্থান কিছুটা রয়ে গেছে এবং সেখান থেকেই এই ব্যাপারগুলো হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।
তিন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার বিষয়ে অ্যাডভোকেট টিপু বলেন, তালিকায় আমার নাম যুক্ত থাকায় আমি হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সীমাহীন অযত্ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে এ তালিকা প্রচার-প্রকাশ করেছে। এ কারণে আমি তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দেওয়ার জন্য তিনটি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আশা করছি, সরকার তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দেবে।
রাজাকারের তালিকা গায়েবের বিষয়ে যা বলেন উপদেষ্টা
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার পলায়নের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলক হকও পালিয়ে যান। এরপর মন্ত্রণালয়ে আর রাজাকারের তালিকার হদিস পাচ্ছেন না কর্মকর্তারা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রাজাকারের তালিকা গায়েবের বিষয়ে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, আমি এ মন্ত্রণালয়ে আসার পর তালিকাটির কোনো হদিস পাইনি। তালিকাটি ওয়েবসাইটেও নেই। এটি পেলে হয়তো আমরা জানতে পারতাম, এতে কার নাম রয়েছে।
নতুন করে কোনো তালিকা করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ৫০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন করে এমন একটি তালিকা করা অত্যন্ত দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের সবকিছু বিবেচনা করেই এগোতে হবে।
রাজাকারের তালিকা গায়েব হওয়ার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত জাহান বলেন, এ ধরনের একটি তালিকা হয়েছিল বলে জেনেছি। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এটি এখন নেই। মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে আসার পর আমি এমন কোনো নথির হদিস পাইনি।