মগজে পঁচন ধরার পেছনে মূল কারণ ভুল শিক্ষা

5

মগজে পঁচন ধরলে সেটি আইন দিয়ে, পুলিশ দিয়ে ঠিক করা সম্ভব না। ক্যান্সারের চিকিৎসা বিষফোঁড়া কেটে সম্ভব নয়। মুমূর্ষ এই সমাজের দরকার কেমোথেরাপি।

আপনি আপনার বোন, স্ত্রী বা স্বজনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হন, পথে পথে আবাল বৃদ্ধ বনিতা , ছোট থেকে বড়, পাদ্রী, পুরুত থেকে টুপিওয়ালা বুড়ো- সবার চোখের দিকে একবার একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাবেন। আর বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না। প্রতি মুহুর্তেই হা করে থাকে এসব ধর্ষকামী ব্যক্তি।

তারা কি বিকৃত যৌন আকাঙ্খা থেকে এটা করে? তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। এটা একটা বিকৃতি। সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। আপনার মাথা যখন পঁচা, মূল্যবোধ যখন শূণ্যের কোঠায়- তখন বিকৃত সমাজকাঠামো দাঁড়াবেই।
পরশুদিন ফেসবুকে এক মোল্লাকে দেখলাম নোয়াখালী অঞ্চলেরই সম্ভবত, ওই আঞ্চলিক টানে বক্তৃতা করছেন, তিনি বেহেস্তে হুরদের বুক, কোমর ও নিতম্বের যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন তা আমার পক্ষে এখানে লেখা সম্ভব নয়। পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে মাইক টানিয়ে উত্তেজক বক্তব্য দিয়ে মূল্যবোধহীন মানুষগুলোকে উস্কে দেয়া হচ্ছে।

আমাদের দ্বিচরিত ভূমিকা দারুণ। আপনি যদি কোন মানুষকে বলেন দোয়া কুনুত বলেন, নিদেন পক্ষে সুরা ফাতিহা, অন্তত দুটা কলেমা- পারবে না বেশিরভাগই। আবার সেই লোকগুলোই ফেসবুকে এমন ভাব নিয়ে জঙ্গি ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে যেন তারা ইসলাম রক্ষার সোল এজেন্ট। ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে আমরা এমন একটি জগাখিচুড়ি মানসিক বৈকল্য তৈরি করেছি তাতে আমাদের এমন হওয়ারই কথা।

তথাকথিত ইহুদি নাসারার দেশের মানুষরা সভ্য হয় কিভাবে? হলফ করে বলতে পারি ইউরোপ আমেরিকার কোন রেলস্টেশনে আপনার বোন বা স্ত্রী একা প্রয়োজনে রাত কাটাতে পারবে। কারও সময় হবে না সেদিকে ঘুরে তাকানোরও। আপনি রাস্তায় টাকার ব্যাগ ফেলে গেলে কেউ সেটা পেলে পাগল হয়ে যাবে মালিককে কিভাবে খুঁজে বের করে ফেরত দেয়া যায়। তাহলে শতকরা আশি ভাগ মুমিন মুসলমানের দেশে এই অবস্থা কেন? এর জন্য কি দায়ী? খুঁজে বের করুন।

আমার মনে হয় আমাদের এই মগজে পঁচন ধরার পেছনে মূল কারণ ভুল শিক্ষা। সেটা পরিবার থেকে শুরু হয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়। আমাদের ছোটবেলায় আমরা শিক্ষকদের দেখলে দশ হাত দূরে দিয়ে চলেছি, এখন? সম্মান জিনিসটা উঠে গেছে। আমরা ছোট থেকেই দেখছি আমাদের পরিবারের প্রতিটি মানুষ লোভ লালসা, অর্থ বিত্ত সব কিছুর পেছনে নোংরাভাবে ছুটছে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের পরিবারের সদস্যরা নোংরা রাজনীতি করছে, খুন খারাবি অপহরণ চাঁদাবাজি, মানুষকে হয়রানি করছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নেই, সবখানেই ফ্যাসিজম। আমরা দেখছি কি করে আমাদের পরিবারের সদস্যরা ঘুষ লেনদেন করছে, কি করে কর ফাঁকি দিচ্ছে, কি করে মানুষের টাকা লুট করে কানাডা আমেরিকায় বাড়ি কিনছে, সুইস ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছে, আমরা দেখছি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাগুরুরা কি করে হালুয়া রুটির ভাগাভাগি নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে, আমরা দেখছি মাদ্রাসায় বলৎকার করে বিকৃত মোল্লারা আটক হচ্ছে, গির্জার ফাদার নারীকে আটকে রেখে ধর্ষন করছে, মক্তব পড়াতে গিয়ে ছোট শিশুকে নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমরা দেখছি কিশোরদের গ্যাং কালচার। আমরা তো সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনা করি নিজেদের, বিশ্বের আর কোন দেশে কিশোরদের গ্যাং আছে! দাড়ি গোফ ওঠেনি এখনো শিশুদের হাতে অস্ত্র আর মাদক আসছে কোথা থেকে?
আমরা দেখছি বাউলদের চুল কেটে বাড়িতে আগুন দেয়া হচ্ছে, পাড়ায় মহল্লার ক্লাবগুলোতে বইয়ের আলমারিতে ধুলো জমেছে- সেসব স্থানে বসছে জুয়া আর মাদকের আসর। আমরা দেখছি জারি, সারি, ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া- আমাদের নিজস্ব সব ঐতিহ্য ধুলোয় মিশিয়ে দিতে।

পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধুলোয় মিশে গেছে সেই কবেই। ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের ছোটবেলাটায় যেমন দেখেছি তা নিশ্চিহৃ হয়ে গেছে।
আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়েই এখন একেটা কিং কোবরার চেয়ে বেশি বিষ। আমরা বিষাক্ত। আমাদের নিঃশ্বাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বিষ। ক্ষমতার মোহে অন্ধ আঞ্চলিক নেতারা মৌসুমী রাজনীতিক কাম সন্ত্রাসীদের এজেন্ট বানিয়ে রেখেছে এলাকায় এলাকায়। তাদের হাতে অপকর্ম হতেই থাকবে। গ্রেফতার হবে। বলা হবে তারা দলের কেউ না। বহিস্কার হবে। আবার নতুন ঘটনা ঘটবে।

আমাদের বিষাক্ত হৃদয়, পঁচে গন্ধ ছড়ানো মগজের চিকিৎসা, মননের চিকিৎসা কেউ করবেন না। আমরা সড়ক নির্মাণে হাজার কোটি টাকা বাজেট রাখলেও সংস্কৃতি, মনন ও মেধার বিকাশে বাজেট রাখি এক হাজার টাকা। কারন আমরা চাই সাধারণ মানুষের মানবিক বৈকল্য তৈরি হোক। তারা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলুক। বোধ বুদ্ধি লোপ পাক।

পুলিশ দিয়ে, ক্রসফায়ার দিয়ে আমরা সংখ্যা বাড়াতে পারবো, দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে না। একই ঘটনা বারবার ঘটবে। ঘটতেই থাকবে।

আমাদের যে জিনিসগুলো দরকার সেগুলো আর কখনো হবে বলে আমি আশাবাদী নই। আমার ব্যক্তিগতভাবে সত্যিই খুব হতাশ লাগে। এই লোভের, হিংসার ক্ষমতার রাজনীতি, বোধহীন সমাজ কাঠামো, বিকৃত ধর্মীয় প্রচারক ও শিক্ষক, লোভী সংস্কৃতিকর্মী, লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক, ধামাধরা বুদ্ধিজীবি সবাই মিলে নিঃশব্দে আমাদের টুঁটি চিপে নিঃশেষ করে দেবে। আমরা তিলে তিলে এক মৃত, ভাবলেশহীন, উদ্বেগ উৎকণ্ঠাহীন, বিবেকহীন, মূল্যবোধহীন, সাংস্কৃতিক চেতনাহীন, সত্যিকারের ধর্মীয় মূল্যবোধহীন এক জাতিতে পরিণত হবো। আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। অন্তত আমি আর আশাবাদী হতে পারছি না বলে দুঃখিত।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)