ভয়ংকর অপরাধে রোহিঙ্গারা, স্থানীয়দের আতঙ্ক

19

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছেন নানা ভয়ংকর অপরাধে। এতে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। গত ৪ বছরে অন্তত ১২ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। এই সময়ে ১ হাজার ২৯৮টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে।

মিয়ানমারে সৃষ্ট সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এর পর ধীরে ধীরে গত চার বছরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ শিবিরে আশ্রয় নেন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। দিন যত গড়াচ্ছে ততই ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। খুন, অপহরণ, মাদক, ডাকাতি, অস্ত্রসহ ১২ ধরনের অপরাধের অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। প্রতি দিন কোনো না কোনো শিবির থেকে রোহিঙ্গা নাগরিক আটক হচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে ভয়ঙ্কর অপরাধের পাশাপাশি স্থানীয়দের ওপরও চড়াও হচ্ছেন তাঁরা।

অধিকাংশ শিবির ঘুরে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের নৈরাজ্যে শিবিরগুলো দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। সেখানে বিভিন্ন কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যও কঠিন হয়ে পড়ছে।

সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ৩টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে হানা দেয়া ভাড়াটে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এ সময় তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী মোহসেনা আক্তারকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে খুন করে তাঁরা।

৩০ জুন রাতে হোয়াইক্যং শামলাপুর সড়ক হয়ে ফেরার স্থানীয় মাহমুদুল করিম ও মিজানুর রহমান রোহিঙ্গাদের হাতে অপহরণের শিকার হন। দুদিন পরে মুক্তিপণ দিয়ে মিজান ফিরলেও মাহমুদুল করিমের কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করে বসে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। বিকাশে কয়েক দফায় ৫৫ হাজার টাকা নিলেও মুক্তি মেলেনি তাঁর। একপর্যায়ে ১ মাস ১২ দিন পরে পাহাড়ে তাঁর অর্ধগলিত লাশ মেলে।

এ ছাড়া তাদের হাতে খুন হন টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। ২০১৮ সালে হোয়াইক্যং উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি আব্দুর রশিদ ও ২০১৯ সালে হ্নীলার জাদিমুড়া এলাকার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক নিহত হন। ২০২০ সালে মুক্তিপণ না পেয়ে জবাই করে হত্যা করা হয় হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মো. সাঈদ (২৮) ও আক্তার উল্লাহকে (২৬)। কাটাখালী এলাকার মো. রশিদকেও (২৫) হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত ৪ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছেন ২ হাজার ৮৫০ জন। এসব অপরাধের মধ্যে আছে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার ইত্যাদি।

এর মধ্যে ৭০টি খুন, ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ৩৪টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা ও অন্যান্য আইনে ৮৯টি মামলা উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি। এতে আসামি সংখ্যা ছিল ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি। আর এ বছর আসামি বেড়ে ৬৪৯ জনে দাঁড়ায়।

গত এক বছর দুই মাসে (২০২০ জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৫৬৭টি। এর মধ্যে অস্ত্র মামলা হয়েছে ২৯টি, মাদক মামলা হয়েছে ৩৬২টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার মামলা ৩০টি, অপহরণ মামলা ১৮টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা ৭টি, পুলিশের ওপর আক্রমণ সংক্রান্ত মামলা একটি, হত্যা মামলা ১৯টি, চোরাচালান মামলা ৫টি, চুরি মামলা ৮ ও অন্যান্য মামলা হয়েছে ৮৯টি। এ সব মামলায় দেড় হাজারের বেশি আসামি হয়েছে।

২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবির নেতা (মাঝি) বজরুল ইসলাম ও ষাটোর্ধ্ব সৈয়দ আহমেদ জানান, পুরোনোর সঙ্গে মিলে নতুন কিছু রোহিঙ্গা শিবিরগুলো নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। তাঁদের কারণে রাতে পালাক্রমে পাহারা বসানো হয়। কিছুদিন আগে শিবিরে ডাকাতদল ঢুকে পড়লে একসঙ্গে তাঁদের প্রতিহত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাধারণ রোহিঙ্গার পাশে থাকার আহ্বান জানান তারা।

বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয় সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারছে না। তাঁদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আবার বেপরোয়া হয়ে পাহাড়ে অবস্থান করছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান, ‘পাহাড়ে বসেই রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা নানা অপকর্ম করেই যাচ্ছেন। আমরা ইতিমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করেছি।’

টেকনাফের ইউএনও মো. পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিদিন খবর আসে রোহিঙ্গারা আাইনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা ইতিমধ্যে সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি। খুব শিগগিরই সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’