ভোলার বোরহানউদ্দিন কেন সহিংস হয়ে উঠেছিল?

ফেসবুক মেসেঞ্জারের একটি স্ক্রিনশটে ইসলাম ধর্মের নবী মোহাম্মদ (সা.) কে কটূক্তির অভিযোগে এর প্রতিবাদ করতে এসে রোববার পুলিশের সাথে সহিংসতায় জড়িয়েছে ‘তোহিদী জনতা’। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের গুলিতে সরকারি হিসাবে ৪ জন মুসল্লি নিহত হয়েছেন।

কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রতিবাদ সমাবেশে কেন গুলি চালাতে বাধ্য হলো পুলিশ? রোববার আসলে কী ঘটনা ঘটেছিল বোরহানউদ্দিনে?

এমন প্রশ্নের জবাবে ভোলার ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ’-এর নেতা মাওলানা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন বলেছেন: প্রশাসনের চাপে রোববার তাদের বিক্ষোভ সমাবেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করে দেবার কারণে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

তিনি বলেন: সমাবেশে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসছিল। কিন্তু সময়ের আগেই সমাবেশ শেষ করে দেয়ার কারণেই পরিস্থিতি সেদিন খারাপ হয়। পুলিশেরও হয়তো তেমন প্রস্তুতি ছিল না পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আর তৌহিদী জনতাও হয়তো ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারাও প্রতিবাদী হয়েছিল।

প্রিয়দেশ নিউজের কাছে সেদিনকার ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী মাজেদুল (ঘটনার বর্ণনা) করেছেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন: প্রশাসনের চাপে সেদিন নির্ধারিত সময়ের আগেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমাম সমাবেশের মোনাজাত শেষ করেন। কিন্তু সমাবেশ যে শেষ, সেটা আগে থেকে মুসল্লিদের জানানো হয়নি। বোরহানউদ্দিনের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ শেষ বলে যখন পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বাধা দেয়া হচ্ছিলো, তখনই মুসল্লিরা সহিংস হয়ে ওঠে।

এই প্রত্যক্ষদর্শী আরও বলেন: এক পর্যায়ে সমাবেশস্থলের কাছে থেকে স্থানীয় বাটামারার ‘পীর সাহেব’ এর সাথে কথা বলার জন্য পুলিশ তাকে ডেকে মসজিদের ভেতরে নিয়ে যায়। তখন গুঞ্জন ওঠে যে, বাটামারার পীর মাওলানা মহিব্বুল্যাহকে আটক করা হয়েছে। এ কারণেও মুসল্লিরা পুলিশের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।

সেদিনকার পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র বাংলা বিভাগ এমন প্রশ্ন রেখেছিল ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান) আসনের এমপি আলী আজম মুকুলের কাছে।

এ প্রশ্নের জবাবে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন: ঢাকায় থাকলেও ওই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বোরহানউদ্দিনে পরিস্থিতি যে উত্তপ্ত হচ্ছে তার সব খবরই আমি ফোনে পাচ্ছিলাম এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনকে আলেম-ওলামাদের সাথে বৈঠক করারও নির্দেশ দেই।

‘কিন্তু তার পরদিন রোববার ঈদগাহ ময়দানে তৌহিদী জনতা নামের একটি ব্যানারে কয়েক হাজার মানুষ ওই হিন্দু যুবকের বিচারের দাবিতে সমাবেশ করে এবং এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে। জনতার ক্ষোভের মুখে পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার খবর জেনেই দ্রুত হেলিকপ্টারে ভোলায় ফিরে আসি। কিন্তু তার মধ্যেই পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে যায়, যাতে চারজন নিহত হয়, আহত হন পুলিশসহ অর্ধশত মানুষ’, বলছিলেন বোরহানউদ্দিনের এমপি।

তিনি বলেন: ‘জেলার পুলিশ সুপার আমাকে ফোন দিয়ে বলছিলেন, স্যার আমাদেরকে বাঁচান। আমরা মসজিদের দোতলায় ইমামের রুমে অবরুদ্ধ আছি, আমাদেরকে বাঁচান। তখনই আমার মনে হলো যে, এ মুহূর্তেই আমার ভোলা যাওয়া দরকার। সাথে সাথেই আমি হেলিকপ্টারযোগে ভোলা চলে আসি। দ্রুত আসার জন্য এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।’

আলী আজম মুকুল বলেন: শনিবার রাতে এ বিষয়ে একটি সুরাহা হলে আলেম-ওলামারা থানায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে রোববারের সমাবেশটি আর হবে না। কিন্তু সকাল দশটার সময় ঈদগাহ মাঠে লোকজন জড়ো হতে থাকে।

‘এতে তৌহিদী জনতার ব্যানারে যে ইমাম সাহেবরা ছিলেন তারা এবং এসপি, এডিশনাল ডিআইজি সাহেবরা বক্তব্য দেন, মোনাজাতও করেন।

এরপর যখন তারা চলে যাবেন তখন ঈদগাহের উত্তর দিকে মানিকার হাট এবং দক্ষিণ দিকে দেউলা শার্শা থেকে দুটি মিছিল আসে। তারা বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফাঁসি দাবি করে এবং সাথে সাথেই প্রশাসনের ওপর চড়াও হয়।’

এমপি মুকুল বলেন: একপর্যায়ে প্রশাসনের লোকেরা আত্মরক্ষার জন্য দৌড়িয়ে ইমাম সাহেবের রুমে ঢোকে। তার পরের ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে আমি দেখেছি যে আলেম সমাজের নেতৃবৃন্দ মানুষকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি জানান: এখানে মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে তাই আলেম সমাজের পাশাপাশি আমজনতাও জড়িয়ে গেছেন। তবে আলেমরা তাদের থামানোর চেষ্টা করেছেন।

ভোলায় পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ

রোববারের সংঘর্ষ এবং পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বোরহানউদ্দিন থানায় যে মামলা হয়েছে তাতে ‘অজ্ঞাত ৪/৫ হাজার ব্যক্তিকে’ অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আরও কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ’। ভোলার এসপি ও থানার ওসিদের প্রত্যাহার এবং ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তরসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছে তারা। এসব দাবি মেনে নিতে প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে।

মুসলিম ঐক্য পরিষদের ছয় দফা দাবি হলো
১. জেলা ও থানা থেকে এসপি এবং ওসিদের প্রত্যাহার করতে হবে
২. ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করার অনুমতি দিতে হবে
৩. আহত লোকজনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে
৪. নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে
৫. অভিযুক্ত বিপ্লব চন্দ্র শুভর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ফাঁসি দিতে হবে
৬. গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে

সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ ৬ দফা পেশ করেন মুসলিম ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সচিব মাওলানা মিজানুর রহমান। সংবাদ সম্মেলন শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা।

এছাড়া এখন সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও পুলিশি প্রহরার মধ্যে ভোলায় দফায় দফায় মিছিল হয়েছে।