পশ্চিমবঙ্গের উষসী চক্রবর্তী নামে এক ছাত্রী ঋতুমতী অবস্থায় প্রথা ভেঙ্গে যে কারনে পুজো করলেন

21

অমিতাভ ভট্টশালী

সম্পাদনা:জিয়াউদ্দীন চৌ:( জেড সেলিম)

কলকাতার এক কলেজ ছাত্রী এবার তার বাড়িতে সরস্বতী পুজো করে সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছেন। তার সঙ্গে তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে পুজোর দিন তিনি ঋতুমতী ছিলেন।ফেসবুকে পুজোর ছবি এবং নিজের শারীরিক অবস্থার কথা ঘোষণা করার পর থেকেই তাকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়ে গেছে।

অনেকেই যেমন মন্তব্য করছেন যে অত্যন্ত সাহসী এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি, তেমনই বদনামও করা হচ্ছে তাকে।

উষসী চক্রবর্তী নামের ২৩ বছর বয়সী ওই ছাত্রীকে নেট নাগরিকদের যে একাংশ ‘ট্রল’ করছেন, তাদের বক্তব্য দুটি – এক, তিনি নারী হয়ে কী করে পুজো করলেন। আর দ্বিতীয়ত, রজঃস্বলা অবস্থায় পুজো করা তো ঘোর পাপ, একেবারে অনর্থ হয়ে যাবে, এমন কি সুনামি বা ভূমিকম্পও হয়ে যেতে পারে এই অনাচারের জন্য।

শাস্ত্র বিশারদ নব কুমার ভট্টাচার্য বলছেন, “কে বলেছে মেয়েরা পুজো করতে পারবে না? এটা একেবারেই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু সেটা নিজের বাড়ির পুজো হতে হবে।”দুদিন ধরে ‘ট্রলড’ হওয়ার পরে মিস চক্রবর্তী ফেসবুকে একটু বক্রোক্তি করেই লিখেছেন যে তিনি ওইসব ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দায় নিয়ে নিচ্ছেন!

মিস চক্রবর্তী বলছেন, “ভেবেচিন্তেই এই প্রথা ভেঙ্গেছি। পিরিয়ড হয়েছে এই কথাটা বলতে আমাকে যেন লজ্জা না পেতে হয়, স্যানিটারি প্যাড যেন লুকিয়ে কিনতে না হয় বা জামার পিছনে রক্তের দাগ লেগে গেলে যেন আমাকে লজ্জায় মুখ লুকোতে না হয়। কেন আমাকে কাগজের মোড়কে বা কালো প্লাস্টিকে মুড়ে স্যানিটারি প্যাড কিনতে হবে!”

“এই কথাগুলো আমার এবং আমার পরের প্রজন্মের মেয়েদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি বলেই প্রথাটা ভেঙ্গেছি। যে কথাটা মেয়েদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বুঝিয়ে আসা হয়েছে, সেটা যে ভুল, সেটাই বলতে চেয়েছি জোর গলায়,” বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছিলেন মিস চক্রবর্তী।

দীর্ঘদিনের প্রথা ভাঙার নেপথ্যে!

“ঋতুমতী হওয়ার মতো একটা স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় মেয়েরা অশুচি হয়ে যায় বলে পুজো করতে পারবে না, সেটা ঘোর পাপ! অথচ যে পুরুষ পুরোহিত পুজো করছেন, তিনি যদি ধর্ষক হন তবুও সেই পুজো শুদ্ধ হয়ে গেল?” মন্তব্য উষসী চক্রবর্তীর।

তিনি বলছিলেন, “আমি এই শুচি অশুচির নিয়ম মানবই না। মন থেকে যদি কেউ শুদ্ধ হয়, তার শুচিতা থাকে, তাহলে আর কোনও কিছুতেই সে অশুচি হয় না – এটাই আমার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমি বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে কোন পুরাণ, কোন শাস্ত্রে এটা লেখা আছে আমাকে দেখাও, তবেই মানব। আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে, তাই বাড়িতে বহু শাস্ত্রের বইপত্র আছে। আমাকে কেউ দেখাতে পারে নি, তাই পুজো করেছি।”

সরস্বতী পুজোয় মেয়ের প্রথা ভাঙ্গা দেখে মিস চক্রবর্তীর বাবা ঠিক করেছেন যে মেয়েকে এবার অন্যান্য পুজো পদ্ধতিও নিজে হাতে শিখিয়ে দেবেন।

শুধু বাবা নয়, ঋতুমতী অবস্থায় নিজে পুজো করার ব্যাপারে উষসী চক্রবর্তী পাশে পেয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের এবং নিজের মাকে।

“ছাত্রীরা আমাকে বলে যে তাদের মায়েরা হয়তো এই প্রথাটা ভাঙ্গতে পারবে না, কারণ এটা তাদের সারা জীবনের সংস্কার। কিন্তু যখন মেয়েরা নিয়মটা ভাঙ্গছে, তখন মায়েরা পাশে দাঁড়াচ্ছে,” বলছিলেন মিসেস ধর্মপাল।

শিক্ষিকা রোহিনী ধর্মপালের কথায়, “উষসী চক্রবর্তী ঠিকই করেছে তো! মেয়েরা ঋতুমতী হলে যে পুজোর কাজে অংশ নিতে পারবে না বা নিজেরা পুজো করতে পারবে না – এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। এগুলো বেদ-উপনিষদে তো নেই। মনুসংহিতা এবং স্মৃতিশাস্ত্র যখন থেকে এল, এটা সেই সময়কার ধারণা। তখন তো রক্তপাত বন্ধ করার বৈজ্ঞানিক উপায় ছিল না – স্যানিটারি প্যাড ছিল না!”

“এখন স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে যদি আমরা সব কাজ করতে পারি ওই কটা দিন, তাহলে পুজো করতে পারব না কেন! আমরা যে পুরোহিত হিসাবে বিয়ে দিতে যাই, তখন তো কই কেউ জিজ্ঞাসা করে না যে আমাদের মধ্যে কেউ ওই দিনটায় ঋতুমতী কী না! পুজো যদি করতে না দেওয়া হয়, তাহলে তো মেয়েদের ওই কদিন সব কাজ থেকেই ছুটি পাওয়া উচিত। কিন্তু সেটা কি কেউ মেনে নেবে?” বলছিলেন রোহিনী ধর্মপাল।

ভারতে স্যানিটারি প্যাডের যেসব বিজ্ঞাপন দেখানো হয় টেলিভিশনে, সেখানেও এই ধারণা দেওয়ারই চেষ্টা করা হয় যে ঋতুস্রাবের কয়েকটা দিন খেলাধুলো থেকে শুরু করে ঝুঁকিপূর্ণ যে কোনও কাজ স্বচ্ছন্দেই করতে পারেন নারীরা।

তবে ভারতে নারী বা ছাত্রীদের মধ্যে এখনও যে অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর-ভাবে কাপড় ব্যবহার করেন ঋতুস্রাবের সময়ে, তা উঠে এসেছিল জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায়।

২০১৫-১৬ এর তথ্য বলছে দেশের নারীদের মাত্র ৪২ শতাংশ স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন।

যদিও জাতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা বা আই সি এম আরের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে ঋতুস্রাব এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা নিয়ে সচেতনতা আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে।

ঋতুস্রাবের কটা দিন শরীর খারাপ থাকে, পেটে ব্যথা হয়, রক্তস্রাব তো হয়ই, তাই নারীদের বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন এবং সেজন্যই শুধু পুজো করা নয়, রান্না করা সহ সংসারের সব কাজকর্ম থেকেই বিশ্রাম দেওয়া হত, একটু দূরে রাখা হত একটা সময়ে।

“কিন্তু পরে, সেটাকেই পুজোয় অংশ না নিতে দেওয়ার মতো একটা ধর্মীয় মোড়ক দিয়ে প্রথা বানিয়ে দেওয়া হল। আমার আপত্তিটা এখানেই। ছোটবেলায় বুঝতাম না, তাই মেনে নিতাম। কিন্তু বড় হয়ে যখন বুঝতে-ভাবতে শিখেছি, তখন প্রথাটা তো ভাঙ্গবই,” বলছিলেন মিস চক্রবর্তী।

উষসী চক্রবর্তীর পরিবার তাকে কোনও লিখিত ধর্মীয় অনুশাসন না দেখাতে পারলেও হিন্দু শাস্ত্র বিশারদরা বলছেন এরকম অনুশাসন আছে যে, রজঃস্বলা নারী কোনও রকম পুজোর কাজে অংশ নিতে পারবেন না।

শাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিত নব কুমার ভট্টাচার্য বলছেন, “মেয়েরা পুজো করতে পারবে না, এরকম কোনও বিধান শাস্ত্রে নেই। একশোবার তারা নিজের বাড়িতে পুজো করতে পারে। কিন্তু রজঃস্বলা অবস্থায় পুজো করায় নিষেধ আছে।”

তার কথায়, এইসব অনুশাসন মনুসংহিতা আর স্মৃতি রঘুনন্দনে উল্লেখিত আছে।

“রক্ত বেরলে ক্ষতাশৌচ হয়। ওই সময়ে কোনও পুজো অর্চনা করা যাবে না। সেটা অবশ্য নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই। সেজন্যই কোনও পুজোর একদিন আগে আমরা দাড়ি কামিয়ে নিই। যদি দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে যায়, তাহলে রক্ত বেরবে, আর তাহলেই আমাকে একদিনের অশৌচ পালন করতে হবে। সেই একই নিয়ম মেয়েদের ক্ষেত্রেও। রজঃস্বলা হলে ত্রিরাত্রি রক্তপাত হয়, তাই ওই সময়ে কোনও শুভ কাজ করা যায় না,” বলছিলেন নব কুমার ভট্টাচার্য।

“কিন্তু কেউ যদি নিয়ম ভাঙ্গে, তাহলে কিই বা করা যেতে পারে। তবে ধর্মীয় নিয়ম আর অনুশাসন ভাঙ্গলে সুনামী আসবে, ভূমিকম্প হবে এসব ফালতু কথা,” মন্তব্য নব কুমার ভট্টাচার্যের।

বেদ- উপনিষদ হিন্দু ধর্মের আকর হলেও সেখানে এধরণের কোনও অনুশাসন নেই। ধর্মীয় অনুশাসনগুলি চালু হয়েছে মূলত স্মৃতিশাস্ত্রের মাধ্যমে। এই স্মৃতিশাস্ত্র রচয়িতারা অনেক সময়েই নিজের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা এবং তৎকালীন সমাজে প্রচলিত নিয়ম ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাদের রচনায়।

এরকমই একটি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য রচিত ‘অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব’। ওই গ্রন্থে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের সব ধরণের ধর্মীয় আচার পালনের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে।

প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা নবদ্বীপে জন্ম নেওয়া এই স্মার্ত পণ্ডিত ওই স্মৃতি নির্ভর গ্রন্থেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুজো অর্চনা নিয়ে বিশদ দিক নির্দেশ দিয়েছেন, যেগুলো এখনও মেনে চলা হয়।

ভারতের পূর্বাঞ্চলে – বাংলা, বিহার, আসাম আর উড়িষ্যায় এখনও রঘুনন্দন ভট্টাচার্য রচিত ‘অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব’ বইটি অনুসরণ করেই সব পুজো অর্চনা করা হয়।রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের অষ্টাবিংশতি তত্ত্বের প্রবল সমালোচনাও আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই।

রোহিনী ধর্মপাল মহাভারত উল্লেখ করে বলছেন, “নার্য্যো ন দূষন্তি ব্যাভিচারেহপি ভর্ত্তৃনাম্। মাসি মাসি ভবেদ্রাগস্ততঃ শুদ্ধাঃ ভবন্ত্যুত । অর্থাৎ কোনও নারী কর্তাকে ত্যাগ করে ব্যভিচার করলেও সেই নারী দূষিত হয় না। তারা মাসে মাসে রজঃস্বলা হয় বলেই তার মাধ্যমেই শুদ্ধ হয়ে থাকে। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য মহাভারতের যে অনুবাদ করেছেন তার অনুশাসন পর্বেই এটা রয়েছে।”

তথ্য:বিবিসি