নোবেল পুরস্কার : কারা,কখন,কেন পান

5

জিয়াউদ্দীন চৌধুরী (জেড সেলিম)

নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের বলা হয় ‘নোবেল লরিয়েট’।১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত নোবেল বিজয়ীরা যে পদক পেতেন, সেটা ছিল ২৩ ক্যারেট স্বর্ণের।এরপর থেকে ১৮ ক্যারেট ‘সবুজ স্বর্ণে’র ধাতবের ওপর ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া পদক দেওয়া হচ্ছে নোবেল বিজয়ীদের।এ ছাড়া একটি সনদ এবং মোটা অঙ্কের অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয় সভ্যতার অগ্রযাত্রায় নানাভাবে অবদান রাখা মহানায়কদের।অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে,নোবেলজয়ীরা ঠিক কত টাকা পুরস্কার পান?টাকার চেয়ে সম্মান অবশ্যই বড়।কিন্তু নোবেল এমনই এক পুরস্কার, যেখানে টাকার অঙ্কটাও হেলাফেলা করার সুযোগ নেই।যদিও অনেক নোবেল বিজয়ী তাঁদের পুরস্কার জয়ের টাকা দাতব্যকাজে দান করে দেন।তার আগে সংগঠন ও সংস্থার মধ্যে তিনবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে শীর্ষে আছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস। ১৯১৭,১৯৪৪ ও ১৯৬৩ সালে রেডক্রস এ পুরস্কার পায়।নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের নাম বেশ গোপনীয়তার মধ্যে রাখা হয়।এরপরও অনেক সময় কারও কারও নাম প্রকাশ হয়ে যায়।

ইতিহাসের পাতা থেকে,

যেখানে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের শরীরে অগণিত মানুষের রক্তের দাগ লেগে আছে।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস। নরওয়ের নোবেল কমিটি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তির দৌড়ে ওবামাই এগিয়ে নয় বরং তিনি অনুসারীমাত্র। অগ্রজদের মতো তিনিও তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার অনেকগুলো দেশের মানুষের রক্তের ওপর দাড়িয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিলেন।ওবামার নির্দেশে ড্রোন বিমান অসংখ্যবার হামলা চালিয়েছে বিভিন্ন প্রান্তে। একই সঙ্গে মিসর এবং লিবিয়াতে সেনা অভিযানও চালানো হয়।অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে তাকে অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট যেমন সিনিয়র বুশ বা জুনিয়র বুশ থেকে আলাদা করা হয়।কারণ ওবামার সিনিয়ররা অনেক অপকর্ম করলেও তিনি কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার লাগামকে সংহত রাখতে পেরেছেন।আবার কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামাই তেল কোম্পানি মালিক, অস্ত্র নির্মাতা ইত্যাদি ব্যবসায়ীকে মুনাফাভিত্তিক খুশি করতে একের পর এক আগ্রাসন চালিয়ে গেছেন।তাও তিনি এসব করেছেন গণতন্ত্র রপ্তানির অজুহাতে।
 
এবার আসা যাক আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের কথায়। তিনি তার মার্জিত ব্যবহার এবং দৃঢ়চেতা মনোভাবের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অপরদিকে, বর্হিবিশ্বের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি বেশ কাজের ছিলেন। রুজভেল্ট ১৯০৬ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তবে তিনি কতটা বিখ্যাত ছিলেন তা ১৮৯৮ সালে কিউবা যুদ্ধ, ১৯০০ সালে নিকারাগুয়ায় যুদ্ধ, ১৯০২ সালে ভেনেজুয়েলায় যুদ্ধ, ১৯০৩ সালে পানামায় যুদ্ধ এবং ১৯০৫ সালে ডোমিনিক রিপাবলিকের যুদ্ধের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। লক্ষাধিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করলেও দ্বিধা করেননি তিনি।

শান্তিতে নোবেল। কিন্তু কোন শান্তিতে, কিসের শান্তিতে নোবেল তা পরিস্কার নয়। অবস্থা আর ঘটনার প্রেক্ষাপটে মনে হয় এটা আসলে স্রেফ একটা শব্দ, সত্যিকারের শান্তি বলতে কিছু নেই। তা না হলে নোবেল কমিটি কিভাবে বিগত সময়ে শান্তিতে নোবেল দেয়ার বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করবেন। আর কতটুকু বেপরোয়া হলে বছরের পর বছর একই কাজ করে যেতে পারে নরওয়ের এই কমিটি। লি ডাক থু এবং হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যকার প্যারিস চুক্তির ফলে ভিয়েতনামী জনগণের ভাগ্যের যে ন্যূনতম পরিবর্তন  হয়নি তা কিভাবে নোবেল কমিটি ব্যাখ্যা করবে? বছরের পর বছর ভিয়েতনামে আগ্রাসন আর রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। মানুষ থেকে শুরু করে জলা-জঙ্গল সবকিছু ধ্বংস করে দিতেও পিছপা হয়নি তৎকালীন নিক্সন-কিসিঞ্জার সরকার। অথচ এই দু’জনকেই দেয়া হয় শান্তিতে নোবেল। লি দুক থু’র নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার জোর থাকলেও কিসিঞ্জারের তা ছিল না। সবাই ভুলে গেলেও ভিয়েতনামের মানুষ অন্তত কখনই ভুলবে না কি ভয়ানক সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র কিসিঞ্জারের। হেনরি কিসিঞ্জার যে যুদ্ধাপরাধ থেকে শুরু করে নানান অপরাধে অপরাধী তা বাংলাদেশ, চিলি, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুর এবং ইন্দোচীনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

শান্তিতে বিতর্কিত নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আরো একটি উদাহরণ মিখাইল গর্ভাচেভ। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট শাসন বন্ধ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করার জন্য তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয় ১৯৯০ সালে।।আর মিখাইল গর্ভাচেভের এই কাজের কারণেই বৃহৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিযে অনেকগুলো রাষ্ট্রের জন্ম নেয়।সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভেঙ্গে গিয়ে যে রাষ্ট্রগুলোর জন্ম হয় তার একটিতেও গণতন্ত্র উপস্থিত নয়। অথচ এই গণতন্ত্রের কথা বলেই গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের বুকে কুঠারাঘাত করেন।

কথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ২০০৬ সালে।ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসার নামে গ্রামীণ মানুষের সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভালো আছেন বলে তিনি যে বৃদ্ধাকে বিশ্বমিডিয়ার সামনে দেখিয়েছিলেন সেই বৃদ্ধাকেই কয়েকমাস পরে অর্ধাহারে অনাহারে মারা যেতে হয়।এ নিয়ে দেশটির প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকায় নিবন্ধও ছাপা হয়।

১৯১৩ সালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাওয়া একটি ব্যতিক্রমই ছিল। শুধু উপমহাদেশের নয়, এশিয়ার প্রথম লেখক হিসেবেও তিনি উক্ত পুরস্কার পেয়েছিলেন।তার ইংরেজিতে অনূদিত তার গীতাঞ্জলীর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন আইরিশ কবি ইয়েটস।একটি সমীকরণ এখানে অনেকেই দেখে থাকেন।১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দিতে ইংল্যান্ড থেকে সম্রাট আসলে রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ-রাজের প্রশংসা করে কবিতা রচনা করেছিলেন। পঞ্চম জর্জকে তিনি ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’ বলে অভিহিত করেছিলেন।পরে এই গানটিই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।তার দুবছরের মধ্যেই তিনি নোবেল পুরস্কারটি পেয়ে গেলেন। অবশ্য কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মর্যাদা খাটো করা যায় না কোন মতেই।

১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমোন পেরেসের সাথে।খবরে প্রকাশ পুরস্কারটি প্রথমে প্রদান করা হচ্ছিল রবিন ও আরাফাতকে।কিন্ত এতে ইহুদি মহল ক্ষেপে যায়।এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির এক নরওয়েজীয় আরাফাতকে পুরস্কৃত করার প্রতিবাদে পদত্যাগ পর্যন্ত করেন।ফলে পেরেসকে অন্তুর্ভূক্তি করা হয়।কিন্তু আরাফাতকে কিভাবে দেওয়া হয়েছিল পুরস্কারটি?তিনি প্রথম ফিলিস্তিনি নেতা হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনিদের জমি ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়ার পুরস্কার ছিল এটি।

ভারতে মানবতার সেবা করার জন্য মাদার তেরেসাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৭৯ সালে।অনেকেই মনে করছেন, তেরেসা সেবা তৎপরতার আড়ালে খৃস্টধর্মই প্রচার করছেন।এই পুরস্কারের মাধ্যমে তার প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন ঘোষিত হয়েছে।বার্মার আংসান সুকিকে ১৯৯১ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়ার নেপথ্যে ছিল দেশটিতে আরো অস্বস্তি সৃষ্টি করা।বার্মার সামরিক জান্তা আমেরিকার তেমন তাবেদার নয়।অন্যদিকে আংসান সুকি পাশ্চাত্যের অনুরাগী।তার স্বামীও ছিলেন ব্রিটিশ।

রাশিয়ার ভিন্নমতালম্বী নেতা আন্দ্রে শাখারভ (১৯৭৫), পোলিশ সলিডারিটি আন্দোলন নেতা লেস ওয়ালেসা (১৯৮৩) পুরস্কারটি পেয়েছেন কমিউনিজম বিরোধী ভূমিকার জন্যই।তিব্বতের দালাইলামা (১৯৮৯) চীনের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা রাখছেন, তার স্বীকৃতিই ছিল ওই পুরস্কারের মাধ্যমে।

নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭টি বছর কারাগারে ছিলেন বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদ করতে যেয়ে।তখন কিন্তু তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি।যখন তিনি সাবেক বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসক এফ.ডব্লিউ.ডি-ক্লার্কের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করলেন, তখন তাকে উক্ত পুরস্কার দেওয়া হলো।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভিএস নাইপলও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।তার বিষয়বস্তুও ছিল মুসলিম বিদ্বেষ।মিসরের নাগিব মাহফুজ নিজের দেশেই বেশ বিতর্কিত।নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিশ্ব রাজনীতির বাইরের কোনো ঘটনা নয়। তাছাড়া পশ্চিমাদের পছন্দীয় কাজ করতে পারলে নোবেল পুরস্কার সহজেই পাওয়া যেতে পারে।নাইপলের নোবেল পাওয়ার ঘটনা সেটাই নতুন করে প্রমাণ করেছে।বলা হয়ে থাকে, তিনি মুসলিম এবং প্রাচ্য বিদ্বেষ সংক্রান্ত ‘নোবেল পাওয়ার সহজপন্থা’ অনুসরণ করেই পুরস্কারটি পেয়েছেন।রাশিয়ার কয়েকজন লেখকের এই পুরস্কারটি পাওয়ায় প্রশ্নটি আরো বড় করে দেখা দেয়।ইভান বুনিন, বোরিস পস্টারনাক, মিখাইল শলোকভ,আলেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিন, যোশেফ ব্রডস্কি-যারা সমাজতান্ত্রিক আমলে নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছেন,তারা সবাই বিতর্কিত।তারা হয় রাশিয়া থেকে বিতাড়িত কিংবা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে প্রচ- রকমের সরব ছিলেন।ইভান বুনিন রাশিয়ার এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি ‘মেমোরিস এন্ড পোট্রের্ট’ গ্রন্থে রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে লিখেছেন।তিনি রুশ বিপ্লবের ভয়াবহতা দেখেই নাকি দেশ ত্যাগ করেছিলেন।
বিশ্বের নানান প্রান্তে মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে ধ্বংসযজ্ঞের কাজে ব্যবহৃত হয় ডিনামাইট। সেই ডিনামাইট বিক্রির অর্থ থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠে নোবেল কমিটির বাৎসরিক তহবিল।আর সেই তহবিলকে বৈধরূপ দিতে প্রতিবছর দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার।আজ যদি আলেফ্রেড নোবেল বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো তার নামের সঙ্গে ‘ডিনামাইট নির্মাতা’ না হয়ে ‘মৃত্যু ব্যবসায়ী’ বিশেষণ যোগ হতো।

মালালার কাছে নাবিলার হার

২০১২ সালের ২৪ অক্টোবর।পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানের এক ছোট্টো গ্রামে নিজের বাড়ির উঠোনে খেলছে আট বছর বয়সী নাবিলা রেহমান।পাশেই তার দাদী মোমেনা বিবি তাকে আর তার ছোটো ভাইকে দেখাচ্ছিলেন কিভাবে গাছ থেকে ঢেঁড়শ তুলতে হবে।উঠোনে খেলতে খেলতেই নাবিলার কানে আসে বিমানের ভারি শব্দ। বিমান দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকাতেই নাবিলা দেখতে পায় একটা আগুনের গোলা ছুটে আসছে তাদের দিকে। প্রচণ্ড শব্দ। তারপর সব অন্ধকার। ধ্বংসস্তুপের মাঝে শুয়ে আছে নাবিলা ও তার ভাই, আর একটু দূরেই ছিন্নভিন্ন লাশ হয়ে আছে তাদের দাদী।

এই ঘটনার অনেকদিন পর ২০১৩ সালে নাবিলা ও তার স্কুল শিক্ষক বাবা ভাগ্যচক্রে তাদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ পান মার্কিন কংগ্রেসে। একটি বেসরকারি এনজিও’র সহায়তায় শেষমেষ তারা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। কিন্তু নির্ধারিত দিনের নির্ধারিত সময়ে কংগ্রেসে গিয়ে দেখতে পান তাদের অভিযোগ শোনার জন্য হাতে গোনা মাত্র পাঁচজন কংগ্রেসম্যান আছেন, অথচ সেখানে থাকার কথা ছিল ৪৩০ জনের। উপস্থিত পাঁচজনের মধ্যে কয়েকজন আবার ঝিমুতে ঝিমুতে নাবিলার বাবার অভিযোগ শুনছিলেন। সেদিন শিশু নাবিলা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাড়িয়ে দেশটির নীতি নির্ধারকদের একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন। যে প্রশ্নের উত্তর যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই বোধকরি দেয়া সম্ভব নয়। নাবিলা খুব সাবলীলভাবে কংগ্রেসম্যানদের জিজ্ঞেস করেছিল ‘কী দোষ করেছিল আমার দাদী যে তাকে বোমা মেরে হত্যা করা হলো?’

শিশু নাবিলা আজও ওয়াজিরিস্তানে থাকে। আর দশটা শিশুর মতো তার স্বাভাবিক জীবন এখন আর নেই। কারণ মার্কিন ড্রোন বিমানের বোমা হামলার ধাক্কা তার মস্তিষ্ক ও শরীর এখনও নিতে পারেনি। এরকম দৃশ্য যে শুধু নাবিলার জীবনেই ঘটেছে তা নয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাকসহ অনেক দেশেই এই চিত্র আমরা দেখতে পাবো একটু খুঁজলেই। অথচ ঠিক এরকমই এক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন আরেক শিশু মালালা। পার্থক্য শুধু একটাই নাবিলাকে হামলা করেছিল মার্কিন ড্রোন আর মালালাকে হামলা করেছিল তালেবান বাহিনী। অথচ আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এই তালেবানদেরই মদদ জুগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের পর বিশ্ব রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিয়ে তালেবানদের প্রধান শত্রু বানিয়ে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের পূর্ব পর্যন্ত আল কায়েদার নাম বিশ্বের সাধারণ মানুষ জানতো না। সংগঠনটি ছিল পৃথিবীর আর দশটা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মতোই একটি।

আজ যখন শিশুদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ তালেবানদের হাতে হামলার শিকার হওয়ার কারণে মালালা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়, তখন মূলত পুরস্কারটা মালালা পায় না।পুরস্কারটা পায় সেই মার্কিনসৃষ্ট তালেবান গোষ্ঠি।কারণ তালেবান ও আল কায়েদাকে এরকম প্রচ্ছন্ন পুরস্কার দিয়ে জীবিত না রাখলে বুশ-ওবামার পক্ষে মার্কিন জনগণের সমর্থন আদায় করা সহজ হবে না।

নোবেল প্রাইজ কতটুকু মহান?

বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান বার্ষিক পুরস্কার হিসেবে নোবেল প্রাইজ সর্বজন স্বীকৃত। ৬টি বিষয়ে (প্রথমে ছিল ৫টি-পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য ও শান্তি, ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতেও পুরস্কার প্রদান শুরু হয়।) মানব-জাতির কল্যাণে সেরা ভূমিকা পালনকারীদের প্রতিবছর উক্ত পুরস্কার প্রদান করা হচেছ। বছর শেষের দিকে এই পুরস্কার কাদের ভাগ্যে জুটছে, তার দিকে থাকে সচেতন সবার নজর।এই পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি সমাজ, দেশে এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। বিশ্বের অন্য কোনো পুরস্কারই এর সমকক্ষ নয়।ডিনামাইট আবিস্কারক আলফ্রেড নোবেলের নামানুসারেই পুরস্কারটির নাম হয়েছে নোবেল।১৯০১ সাল থেকে প্রদান করা হয় এই পুরস্কার। তিনি ১৮৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যান। অর্থাৎ তার জীবদ্দশায় তিনি এই পুরস্কার প্রবর্তন করেননি।
তবে অনেকের মতে, যতটা মহান মনে করা হয়, এই পুরস্কার ততটা মহান বা মহৎ নয়। বরং বলা যায়, পশ্চিমা আদর্শ, দর্শন প্রচারের অন্যতম এক হাতিয়ার হিসেবে একে ব্যবহার করা হচ্ছে।একটু গভীরভাবে চোখ বুলালেই দেখা যাবে, উদার মানবতাবাদীর প্রবক্তার ছদ্মাবরণে পশ্চিমা আদর্শ, মূল্যবোধ ও লক্ষ্যপূরণের জন্যই এই পুরস্কার। এতে বর্ণবাদী ইহুদি, কট্টরপন্থী খ্রিস্টান সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।বিশেষ করে গত অর্ধ-শতাব্দী ধরে এই পুরস্কারটি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর লক্ষ্যসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বৃটিশ সাম্রাজ্য যখন সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল,তখন তারা কিংবা তাদের অনুগ্রহভাজনরাই পেত পুরস্কারটি। আর এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের পর পুরস্কারটি সেদিকেই যাচ্ছে। তবে ৬টি পুরস্কারের মধ্যে শান্তি, সাহিত্য এবং অর্থনীতির পুরস্কারটি নিয়েই অনেক বেশি রাজনীতি হয়ে থাকে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে সাধারণভাবে তৃতীয় বিশ্বের খুব একটা অবদান নেই। কিন্তু অন্যগুলো বিশেষ করে শান্তি পুরস্কার নিয়েই রাজনীতি হয় সবচেয়ে বেশি।

নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক হচ্ছেন আলফ্রেড নোবেল। পুরো নাম আলফ্রেড বার্নাড নোবেল। সুইডেনের এই প্রসিদ্ধ রসায়ন বিজ্ঞানী ১৯৩৩ সালের ২১ অক্টোবর স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন।আর মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯৬ সালের ১০ই ডিসেম্বর ইটালির সান রেমোতে নিজের বাসভবনে।তার পিতা ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন প্রসিদ্ধ টর্পেডো ও মাইন নির্মাতা এবং খ্যাতনামা গবেষক। নোবেল ছিলেন তার পিতামাতার (ইমানুয়েল ও ক্যারোলিন নোবেল) ৮ সন্তানের ৪র্থ পুত্র। অবশ্য তার মাত্র চার ভাই কৈশোর অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল।আলফ্রেড নোবেল একাধারে আবিস্কারক, শিল্পপতি ও প্রকৌশলী। শৈশবে তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। এজন্য তিনি মায়ের সান্নিধ্য বেশি পেয়েছিলেন। বাড়িতেই তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নামি অধ্যাপকদের কাছে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য এবং বিদেশি ভাষা শেখেন। মাতৃভাষা সুইডিশ ছাড়াও রাশিয়ান, ফরাসি, ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন।
তার কর্মউদ্দীপনা ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি একই সাথে ছিলেন উদ্ভাবক, শিল্পপতি এবং সফল শিল্প পরিচালক। অসংখ্য আবিস্কার ছাড়াও তিনি ২০টিরও বেশি দেশে প্রায় একশত কারখানা পরিচালনা করেছেন তেমন কারো সাহায্য ছাড়াই। ব্যবসায়ের জন্য তিনি নিয়মিত বিদেশ সফর করতেন। একারণে ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো তাকে ‘ইউরোপের সবচেয়ে ধনী বাউন্ডুলে’ হিসেবে বর্ণনা করেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি প্রথম পেটেন্ট নেন ‘বিস্ফোরক তেল’ আবিস্কারের জন্য।আর মৃত্যুর সময়ে তার ব্যক্তিগত পেটেন্টের সংখ্যা ছিল ৩৫৫। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাস ছিল প্রচণ্ড।তিনি তথাকথিত ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে নিজের দাবি থেকে সরে আসার মতো বোকামি কখনো করেননি।
আলফ্রেড নোবেলের জটিল ব্যক্তিত্ব এবং ব্যতিক্রমধর্মী চালচলন সমসাময়িকদের ধাঁধায় ফেলে দিত। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘনঘন যাতায়াত করলেও তিনি বেশির ভাগ সময় কাটাতেন একাকি। কখনো বিয়ে করেননি। নাটক, কবিতা ইত্যাদি রচনা করলেও প্রকাশ করেননি।
ব্যক্তি জীবনে তিনি উদার হিসেবে পরিচিত হলেও গণতন্ত্রের প্রতি তার কোন আস্থা ছিল না।তাকে অনেকে হতাশাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এমনকি মহিলা ভোটাধিকারেও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রতি তিনি একজন ‘ভালো’ স্বৈরাচারের ভূমিকা পালন করতেন।এমনকি তিনি একটি সুইডিশ হোটেলে একটি পুরাতন কাগজে নোবেল পুরস্কারের উইলের খসড়া চূড়ান্ত করেছিলেন।আর কোন আইনজীবীকে নয়, বরং পরিচিত চারজনকে সাক্ষী রেখে উইলে স্বাক্ষর করেন তিনি।তিনি আইনজীবীদের বিশ্বাস করতেন না।
ছোটবেলা থেকেই নোবেল রসায়নবিদ্যার প্রতি ছিলেন। পিতার নিকট থেকেই তিনি টর্পেডো ও মাইন বিদ্যা শেখেন। পিতা অবশ্য কিছুদিন পরেই সেন্ট পিটার্সবাগের চাকরি ছেড়ে স্টকহোমে ফিরে আসেন। তখন সবেমাত্র ‘নাইট্রোগ্লিসারিন’ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এই পদার্থটির নিরাপদ ব্যবহার জানা ছিল না। এ নিয়েই শুরু হলো গবেষণা। ১৮৬২ সালে কাইজেলগার নামক এক ধরনের সছিদ্র মাটি দিয়ে নাইট্রোগ্লিসারিনকে শোষিত করিয়ে সুষ্ঠু ও নিরাপদে বিষ্ফোরণ ঘটানোর কৌশল আবিস্কার করেন। পরে আরো গবেষণা করে ১৮৬৭ সালে ডিনামাইট আবিষ্কারের প্যাটেন্ট লাভ করেন। তিনি নানা ধরনের ডিনামাইট আবিস্কার করেন। এই আবিস্কারে নোবেলের ভাগ্য খুলে যায়। যুদ্ধে ডিনামাইটের বিপুল চাহিদা দেখা দেয়। এটা ছিল তখনকার দিনে সবচেয়ে বিধ্বংসী বিস্ফোরক। ডিনামাইটকে এখনো বিস্ফোরক দুনিয়ার অন্যতম বিধ্বংসী আবিষ্কার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া রাস্তা, রেললাইন ইত্যাদি নির্মাণ, খনিতে ব্যবহারের জন্যও প্রচুর ডিনামাইটের প্রয়োজন হতো। তিনি একচেটিয়া ব্যবসা করতে থাকেন। তিনিই এই বিস্ফোরকটির নাম ডিনামাইট রাখেন। এটি তিনি নিয়েছিলেন গ্রিক শব্দ ‘উুহধসরং’ থেকে, যার অর্থ ‘ঢ়ড়বিৎ’। ১৮৭০ ও ১৮৮০ দশকে তিনি ইউরোপ এবং আমেরিকায় ডিনামাইটের কারখানা গড়ে তুলতে থাকেন। মৃত্যুর সময়ে তার প্রায় ৯০টি কারখানায় বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ তৈরি হচ্ছিল। তিনি তখন বিস্ফোরক আর গোলাবারুদের অঘোষিত সম্রাট হিসেবে অভিহিত হচ্ছেন। এমনকি এজন্য অনেকে তাকে ‘মৃত্যুর সওদাগর’ পর্যন্ত বলতো। ১৮৮৮ সালে ফ্রান্সে তার ভাই লুদভিদ নোবেল নিহত হয়। তখন অনেকে মনে করেছিল আলফ্রেড নোবেলেরই মৃত্যু হয়েছে। তাই একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মৃত্যুর সওদাগরের মৃত্যু’। এই খবর তাকে চঞ্চল করে তুলেছিল।

এই লোকটিই নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা করে যান অনেকটা সবার অলক্ষ্যে। ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি প্যারিসে একটি উইল করেন। স্টকহোমে একটি ব্যাংকে তিনি তার উইল জমা রাখেন। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যরা বিস্মিত হয়ে পড়ে। তারা উইলটিকে বানচালের ব্যর্থ প্রয়াস চালান। ফলে পুরস্কার ঘোষণায় বিলম্ব হয়ে যায়। নোবেল পুরস্কারের জন্য তার দানকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার, বর্তমানে যার মূল্য প্রায় ১৫০ কোটি ক্রোনার। ব্যাংকে গচ্ছিত উক্ত অর্থের সুদ থেকেই প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। উইল অনুযায়ী ১৯০০ সালের ২৯ জুন স্টকহোমে গঠিত হয় নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কারটির সাথে বিপুল পরিমাণে অর্থ সংশ্লিষ্ট থাকায় শুরুতেই তা আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্বের সেরা পুরস্কার হিসেবে অভিহিত হতে থাকে এটি। অবশ্য বুদ্ধি এবং মননশীলতার চর্চায় তা বিশ্বকে বিভক্তও করে ফেলে। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পরিবেশ, দর্শন, রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কারো পক্ষে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সম্ভব নয়। পুরস্কারের জন্য নোবেল কেন ৫টি বিষয়কে বেছে নিয়েছিলেন তা পরিস্কার নয়। তবে তিনি যেহেতু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এবং পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন, তাই এই দুই বিভাগে পুরস্কার ঘোষণা সহজেই বোধগম্য। আর শরীরবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানেও তার আগ্রহ ছিল। তিনি তার হতাশা কাটাতেন ফিকশন, নাটক ও কবিতা লিখে। তাই এ দুটি বিষয়ে পুরস্কারও বোধগম্য। বরং শান্তিতে পুরস্কার ঘোষণা কিছুটা দুর্বোধ্য। অনেকে বলেন, তিনি যে ধ্বংস ছড়িয়েছিলেন, তার কাফফারা ছিল এই পুরস্কারে। কিন্তু তার জীবদ্দশায় ডিনামাইট যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি, তখন তা উন্নয়ন কাজেই ব্যবহৃত হতো। খনি উন্নয়ন, খাল খনন, রাস্তা নির্মাণে ডিনামাইটের ব্যাপক ব্যবহার হতো।