নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্তত তিনটি সুপারিশের কড়া সমালোচনা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। বিশেষ করে বিদায় নেওয়ার পর ইসির বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাতে তদন্তভার প্রদান, সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকার জন্য স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে তা ইসির স্বাধীনতা ‘খর্ব করবে’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
গতকাল রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ‘রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সিইসি এসব বলেন।
তিনি জানান, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ইসির বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাতে তদন্তভার দিলে এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা নিয়ে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ করার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে তা ইসির ক্ষমতাকেও সংকুচিত করবে। সব সুপারিশ ভালো বা খারাপ বা ইসির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা নিশ্চিত নয়। তিনি বলেন, ‘সুপারিশ তো অনেক দেওয়া যায় কিন্তু যিনি বাস্তবায়ন করেন তিনিই জানেন সেই সুপারিশ আসলেই বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়ন যোগ্য কিনা (হোয়েদার ইট ইজ রিয়েলি প্র্যাকটিকেবল, রিয়েলি ইমপ্লিমেন্টেবল অর নট)।
সিইসি জানান, ইসির চারটি ‘সাংবিধানিক ম্যান্ডেট’ রয়েছে, সেগুলো হলো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সংসদ নির্বাচন, ভোটার তালিকা ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ। এ চারটির বাইরে সংবিধানে ক্ষমতা দেওয়া না থাকলেও সরকারের অনুরোধে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইলেকশন ও পার্লামেন্ট ইলেকশন বাদ দিয়ে ভোটার তালিকা ও সীমানা পুনর্নির্ধারণের ম্যান্ডেট আস্তে আস্তে ইসির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘এ বিষয়ে বিস্তারিত আমি জানি না, উনারা বলেছেন এটা একটা স্বাধীন কর্তৃপক্ষ হবে।’ নির্বাচন কমিশনই তো স্বাধীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার মধ্যে আরেকটা স্বাধীন দিলে তো আরেকটা মুশকিল। ইসির কাছ থেকে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা সরিয়ে নিলে বা এমন কোনো শর্তারোপ করলে যাতে কমিশন অভিযোগগুলো ফিক্স করতে না পারে বা বিবেচনার সময় বাধার সৃষ্টি হলে বিশাল সমস্যা দেখা দেবে।’ তিনি বলেন, ‘ডিলিমিটেশন ইসির কন্সটিটিউশনাল ম্যান্ডেট, এটার উপর ইসির নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।’
এএমএম নাসির উদ্দিন আরও জানান, ভোটার এনআইডি কার্ড, ভোটার রেজিস্ট্রেশন একটা স্বাধীন অধিদপ্তর/পরিদপ্তরে হ্যান্ডওভার করার জন্য সাজেস্ট করা হয়েছে। আরেকটা কর্তৃক্ষকে এই দায়িত্ব দিলে ইসির কি তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে? ইটস ইমপসিবল। তিনি বলেন, ‘ভোটার নিবন্ধন অন্যের কাছে দিয়ে দেওয়া অথবা ডিলিমিটেশন অন্যের কাছে দিয়ে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের কন্সটিটিউশনাল ম্যান্ডেটের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে, এ স্পিরিটের বিরুদ্ধে। আমাদের জন্য এ ধরনের সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নয়। পরবর্তীতে তারা সিদ্ধান্ত নিলে বা সংবিধান সংশোধন হলে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে এটা গ্রহণযোগ্য না।’
সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে সিইসি জানান, আরেকটা সাজেস্ট করেছেন- নির্বাচন কমিশনার যদি ব্যর্থ হয়ে যায় বা শপথ ভঙ্গ হয় তাহলে পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। এ ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করেন এই ব্যবস্থায় ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে, স্বাধীনতা কম্প্র্রমাইজড হবে। ইসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন রাষ্ট্রপতি চেয়ারে থাকার সময় ইম্যুনিটি ভোগ করছেন, চেয়ার থেকে নামার পর অনেক রাষ্ট্রপতিরও বিচার হয়েছে এবং বিদ্যমান আইনেই হয়েছে, নতুন আইন করা লাগেনি।’
নতুন ইসি গঠনে বিদ্যমান আইন সংস্কার করে ‘সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনের খসড়া ’ প্রস্তাবনা নিয়েও সমালোচনা করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনছি- উনারা আইনের একটা খসড়া দিয়েছে কমিশন গঠনের জন্য; কি দিয়েছেন আমি জানি না। কোনো ল’ গেলে, দুটি জিনিস দরকার। আমার জন্য আইন বানালে আমাকে জানাতে হবে, দেশের জনগণকে জানাতে হবে। কারণ আইন বানানোর প্রসিডিউর আছে, ওয়েবসাইটে দিতে হবে। ইট ইজ লং টাইম কনজিউমিং প্রসেস।’
সময়মতো নির্বাচন করতে ইসির সামনে যত চ্যালেঞ্জ
ওই অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হলে তফসিল ঘোষণাসহ ভোট সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করতে হবে। অক্টোবরের শেষের দিকে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের মাঠ প্রস্তুত নয়। সংস্কার চূড়ান্ত না হওয়ায় সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের মতো প্রস্তুতিমূলক কাজ আটকে আছে।
তিনি বলেন, ‘আমাকে আইন-কানুন বিধি-বিধান সংশোধনের কাজ সমাধান করে অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুতি নিতে পারি সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্যে যদি নতুন আইন করতে হয়, সংস্কার করতে হয়, তাহলে আমার জন্য ইট উইল বি এ বিগ চ্যালেঞ্জ। সবার জন্য।’
মাঠ রেডি নেই; দল নিবন্ধন ও সীমানা পুননির্ধারণ আটকে আছে
১৫টা সংস্কার কমিশন কাজ করছে। এখন যার জন্য রুলস অব দ্য গেম কি হবে ফিক্স করতে পারিনি। নির্বাচনের আইন-কানুন বিধি-বিধান চূড়ান্ত অবস্থায় নেই। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট আসতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, উই আর নট স্টিল সিউর এবাউট ইট।
সীমানা পুনর্নির্ধারণে দেড়শ’ আবেদন এসেছে। এসব নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। সিইসির ভাষ্য, আইনের মধ্যে এমনভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে যেন ফিক্স করতে না পারি। আইনটা সংশোধন করতে হবে। এটা নিয়ে আটকে যাচ্ছি। পার্টি রেজিস্ট্রেশেন, এনাদার টাইম কনজিউমিং প্রসেস।
আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না ইসি:
আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ইসি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে জানিয়েছেন সিইসি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণা হলে সে সময় যতগুলো দল নিবন্ধিত থাকে আমরা তাদের নিয়ে নির্বাচন করি। এখন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নিবন্ধনের ধরন পাল্টে যাবে। যেটা বলতে চাই, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তফসিল পর্যন্ত যারা নিবন্ধিত থাকবে, অপেক্ষা করছি ওই পর্যন্ত। তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত, কয়টা পার্টি নিবন্ধিত থাকে আমরা দেখতে চাই। অপেক্ষা না করে তো বোঝা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে আওয়ামী লীগ নিয়ে। আমরা দেখতে চাই কীভাবে সমাধান হয়। আমরা প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে শুনেছি যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে, কি করবে না এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে। আমরা তা মিডিয়াতে দেখেছি। আপনারাও দেখেছেন হয়তো। তবে এ সিদ্ধান্ত ইসি নেবে না।
সূত্র : ইত্তেফাক