নদীবাঁধে আস্থা কেন সেনাবাহিনী?

জুনাইদ আল হাবিব: আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, দেশপ্রেমিক কারা? আমি বলব, তরুণরাই। এ তারুণ্যের শক্তি এতটাই প্রবল যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশ তরুণদের বুকভরা সাহসের বলে পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। যুগে যুগে তরুণরা দেশের বড় বড় বিপর্যয়ে রেখেছে সাহসী ভূমিকা। দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে এ তরুণরাই যোগ দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। সৈনিক পদে আসীন হয়ে দেশমাতৃকার টানে অকুতোভয় দুঃসাহসী ভূমিকা রাখে তারা। কোভিডকালেও আমরা দেখেছি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর প্রশংসনীয় উদাহরণ।

মানুষের ঘরে ঘরে কোভিডকালে খাবার পৌঁছে দিয়েছে সেনাবাহিনী। দেশের কঠিন দুর্যোগ মুহুর্তে সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় লকডাউন সফল এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কোন প্রসঙ্গে আমি এ কথাগুলো বলছি, বোঝতেই হয়তো অনেকের দেরি হয়নি। নদীবাঁধ বা বেড়িবাঁধ। উপকূলজুড়ে জলোচ্ছ্বাসে ভাসা মানুষের এখন প্রাণের আকুতি হয়ে দাঁড়িয়েছে মজবুত, টেকসই বেড়িবাঁধের। উপকূলজুড়ে এ আন্দোলনও ছড়িয়ে পড়ছে৷ গণমাধ্যম মারফতে জানা যাচ্ছে, নিজেরাই মানবঢাল হয়ে বেড়িবাঁধকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা করছে। এ খবর নোয়াখালীর দ্বীপ হাতিয়ার।

অন্যদিকে সুন্দরবন লাগোয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি ঘূর্ণিঝড় আম্পান, পরবর্তী জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পুরো এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। জোয়ারের পানি ঢুকে চিংড়ির ঘের নষ্ট হয়েছে। নোনাজল ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। মানুষের জীবনমানে পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। বেড়িবাঁধ না থাকায় একই চিত্র দক্ষিণাঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুরে। মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে দীর্ঘ ৩৬বছর একদিকে যেমন এই এলাকায় নদীভাঙনে মানুষ বাস্তুভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন, অন্যদিকে নতুন করে লবণ পানি ঢুকে পড়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দিয়েছ চরমভাবে। মানুষজন বলছেন, এ সমস্যা বেশি দিনের নয়। দু’এক বছরে ব্যাপক লবণপানির অস্তিত্ব মিলছে। গাছপালা মারা যাচ্ছে, বসতভিটার ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে এ লোনাপানির কারণে৷

উপকূলজুড়ে এ মানবিক সংকট মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর মেঘনার অব্যাহত ভাঙন প্রতিরোধে সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া জানিয়ে আসছিল লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগরের মানুষ। গত একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরে পাস হয় এ জনপদের ৭লাখ মানুষের দীর্ঘদিনের আশা ভরসার ৩হাজার ১’শ কোটি টাকা বাজেটের একটি বেড়িবাঁধ প্রকল্পের। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মানুষ। কিন্তু এরই মাঝে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, একটি মজবুত বেড়িবাঁধ হবে কী বিশাল এ জনপদে? সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে গৃহিত প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা, সেটা নিয়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলেই মানুষের প্রতিক্রিয়া মেলে।

স্থানীয় মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে শোনা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আসে ব্যবসা করে৷ তাদের কাছে মানুষের হাহাকার মূল্যহীন। পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হলে লুটপাটের সুযোগ নেয় রাজনৈতিক, প্রভাবশালী গোষ্ঠী।

কেন এই উদ্বেগ আর আশঙ্কা! মাঠচিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬সালে মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধে সরকার রামগতি ও কমলনগরে পরীক্ষামূলক বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রামগতির আধুনিক শহর চর আলেকজান্ডারকে ঘিরে সাড়ে ৩কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সেনাবাহিনীর অধীনে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। পুরো বাঁধ টিকে যায়। পরিণত হয় পর্যটন কেন্দ্রে। শুধু ওই এলাকার মানুষের দুঃখ ঘোচেনি, জেলা শহর ও আশপাশের জেলা শহর থেকে এ বেড়িবাঁধে প্রতিনিয়ত ভিড় জমে হাজার হাজার মানুষের। ঈদ-উৎসব, ছুটির সময়ে স্থানটিতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। ঠিক বিপরীতে একই প্রকল্প পাশের উপজেলা কমলনগরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ১কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। যেখানে দেখা গেছে, ওই বাঁধটি নির্মাণের ১ বছরের মধ্যে ১০ বার ধসে পড়েছে!

সম্প্রতি রামগতি-কমলনগর রক্ষায় একনেকে পাস হওয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এমন খবর কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এ জনপদের মানুষ। কারণ, পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করলে যে কোন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করাবে। এতে কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। কারণ, তাদের কাজের পূর্ব ইতিহাস মানুষের মাঝে ব্যাপক নেতিবাচক। আর সেজন্যই সরকারের বিশাল এ প্রকল্পের সঠিক তদারকি এবং অন্তত মানবিক বিবেচনায় হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সেনাবাহিনীর হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করা উচিত।

সেনাবাহিনী দিয়ে বাঁধ নির্মাণের এমন দাবি বিশ্লেষণ করলে দেখা গেছে, দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ সেনাবাহিনী দিয়ে নদীবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে একমত। সুতরাং, সরকার জনদাবিকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প যেনতেন কোন প্রতিষ্ঠানের উপর ছেড়ে দিতে পারে না। পূর্বের অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আবেগকে মূল্যায়ন করে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করলে বিশাল একটা এলাকার মানুষ কেবল উপকৃতই হবে না, অর্থনৈতিক স্বনির্ভর হয়ে উঠবে নদীপাড়ের ৭লাখ মানুষ। যা রাষ্ট্রের জন্য বড় একটি ব্যাপার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)