দেনমোহর নিয়ে সমাজের কপটতা

14

আমাদের দেশে প্রায়শই উদ্দেশ্যমূলক ভাবে দেনমোহর নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। অনেক উদ্ভট ধারণাও সমাজের অনেকের ভেতর আছে। স্ত্রী যদি স্বামীকে আগে ডিভোর্স দেন, তখন অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা হয় না। স্ত্রী যেহেতু নিজ ইচ্ছা থেকে এবং নিজ দায়িত্বে ডিভোর্স দিচ্ছেন, তাই তাকে দেনমোহরের টাকা না দিলেও হবে- এটি চরম একটি ভ্রান্ত ধারণা। সবাইকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, স্বামী বা স্ত্রী যিনিই ডিভোর্স দিন না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে পরিশোধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেনমোহর বিয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত, ডিভোর্সের সাথে নয়।

আইন অনুযায়ী দেনমোহর স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কারণ দেনমোহর সব সময়ই স্বামীর ঋণ। দেনমোহর দাবি করার পর যদি স্বামী উক্ত দাবি পরিশোধ না করেন, স্ত্রী চাইলে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকতে পারবেন এবং ওই অবস্থাতেও স্বামী অবশ্যই তার ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন। স্বামীর মৃত্যু হলেও বকেয়া দেনমোহর একটি ঋণের মতো এবং ইহা শোধ করতেই হবে। স্বামীর উত্তরাধিকারীরা ইহা দিতে বাধ্য। অন্যথায় মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে আদায় করতে পারবেন। স্ত্রী যদি আগে মারা যান, তবুও দেনমোহর মাফ হবে না। স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহরের দাবিদার। তারাও মামলা করার অধিকার রাখেন। কেননা দেনমোহর পাওয়া স্ত্রীর শুধু আইনতই নয়, ধর্মীয় অধিকার। স্থানীয় সহকারী জজ আদালত যেখানে পারিবারিক আদালতে দেনমোহর সংক্রান্ত মামলা করা যায়। ১৯৮৫ সাল থেকে এই আদালত পারিবারিক আদালত হিসেবে বিচারকার্য সম্পাদন করে আসছে। তবে সেক্ষেত্রে ডিভোর্স বা স্বামীর মৃত্যুর পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।

অনেক সময় ডিভোর্সের পর অথবা আলাদা হওয়ার পর স্ত্রীকে স্বামী অনেক সময় নানান অজুহাতে দেনমোহরের টাকা দিতে চান না। ফলে স্ত্রী মামলা দায়ের করতে বাধ্য হোন। মামলা করে আইনের জটিলতায় পড়ে অনেক সময় তাকে লম্বা একটা সময় আদালতে ঘুরপাক খেতে হয়। ডিভোর্স বা আলাদা হওয়ার সময় যদি স্বামী স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে দেন, তাহলে আর স্ত্রীকে হয়রানির শিকার হতে হয় না। প্রত্যেক স্বামীর উচিত তাদের স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে দেয়া।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে দেনমোহর দেওয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু তা দেওয়ার ইচ্ছে নেই, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট জিনাকারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।’

এছাড়া দেনমোহর নিয়ে সমাজে প্রচলিত একটি বিশেষ পরিচিত কপটতা হলো, বিয়ের প্রথম রাতেই স্ত্রীকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে দেনমোহর মাফ করিয়ে নেওয়া। বিয়ের রাতে যে কোনো নারী মানসিকভাবে দুর্বলচিত্তে থাকেন। এছাড়া দেনমোহরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত না থাকায়, স্বামী যদি দেনমোহর মাফ চান, তখন লজ্জা থেকে ‘না’ বলার মতো অবস্থায় যেতে পারেন না, পাছে স্বামী তাকে লোভী ভেবে বসে। মোহর নিয়ে এ ধরণের কপটতার আশ্রয় নিতে পবিত্র কোরআনে ও ইসলামি জীবন ধারায় কঠোরভাবে নিষেধ রয়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যদি কাবিননামায় দেনমোহর হিসেবে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দেয়ার কথা উল্লেখ না থাকে তবে স্ত্রীকে উপহার হিসেবে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দিলে তা দেনমোহর হিসেবে পরিশোধ হবে না। এক্ষেত্রে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা থাকতে হবে।

যেমন- জমি হস্তান্তর দলিলে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা না থাকলে এ ধরণের জমি-দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না। স্বামী স্ত্রীকে কোনো উপহার দিলে সেটি দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে না। বিয়ের পর স্বামী ভালোবেসে স্ত্রীকে অনেক কিছুই উপহার হিসেবে দিতে পারেন। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে।

মনে রাখবেন শেষ বিচারের ময়দানে কোন আদালত, বিচারক, আইনজীবী থাকবেন না। সেখানে থাকবেন এই জাগতিক সবকিছুর একমাত্র অধিপতি আল্লাহ্‌ সুবহানাতায়ালা। আজ যদি দেনমোহর পরিশোধে খামখেয়ালি করেন তাহলে শেষ বিচারের ময়দানে ব্যাভিচারের দায়ে অভিযুক্ত হতেই হবে। দেওয়ানি আইনের ভয়ে দেনমোহর পরিশোধ করার চেয়ে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশকে সম্মান করে ভালোবেসে স্ত্রীর সম্মানে মোহরানা আদায় করবেন। দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি কোন দান নয়, ইহা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সম্মান।

লেখক: ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান