বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকার আহম্মেদ মোল্লা সড়কের বাসিন্দা শামীম হোসেন তার পনেরো বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালে। বমি, পাতলা পায়খানা কমছে না কিছুতেই। ডাক্তার জানিয়েছেন, দূষিত পানি পান করায় পেটে ব্যাকটেরিয়া ঢুকে পড়েছে। নিয়মিত ওষুধ সেবনের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি পানের পরামর্শ ডাক্তারের।
শামীম বলেন, রোববার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই মিলে রূপাতলীরই একটি রেস্তোরাঁয় নাশতা করি। সেখানে গ্লাসে দেওয়া পানি পান করি। এরপর থেকে ঘরের তিনজনেরই পেটে ব্যথা। আমি আর স্ত্রীর বেশি কিছু না হলেও ছেলেটা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে।
শামীম হোসেনের দেওয়া তথ্যে যোগাযোগ করা হয় সেই রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক বলেন, সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে মাটির গভীরের পানি তুলে খাবারের জন্য রাখা হয়। সেই পানি আবার ট্যাংকিতে জমিয়ে ব্যবহার করা হয় প্লেট-গ্লাস ধুতে। পানিতে সাধারণত সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু হতেও পারে।
পানিতে বিষাক্ত কিছু মিশে যাচ্ছে কিনা কিংবা ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য তাদের কাছে কোনো উপায় নেই স্বীকার করে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও করপোরেশনের লোক এসে হোটেলের পানি নিয়ে পরীক্ষা করতেন। এখন তারাও আসেন না, আমাদেরও যাওয়া হয় না। দূষিত পানি খেলেও করার কিছু নেই।
শামীম হোসেনের তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেলো অন্যসব খাবার হোটেলে। নগরীতে ব্যবসা পরিচালনা করা এমন তিন হাজারের বেশি হোটেল-রেস্তোরাঁ তাদের ভোক্তাদের কি বিষাক্ত নাকি বিশুদ্ধ পানি দিচ্ছেন তা জানেন না। এমনকি বাসাবাড়িতে সরবরাহকৃত পানি পরিশোধিত কিনা তা জানারও কোনো উপায় নেই। শুধু যে বরিশাল শহর—এমনই নয় বিভাগের সবগুলো জেলা-উপজেলা শহরের একই অবস্থা।
বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরে পানির গুণগত মান পরীক্ষার একমাত্র ল্যাবটি তিন বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বিভাগের প্রায় ১ কোটি মানুষ।
জাকির হোসেন নামে এক বাসিন্দা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে শহরের বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা বাসাবাড়িতে সরবরাহকৃত পানির স্যাম্পল কালেকশন করে তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। পানি ভালো আছে কিনা, পানিতে জীবাণু মিশ্রিত কিনা। কিন্তু গত প্রায় ১০ বছরেও আমি দেখিনি সিটি করপোরেশন পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে।
বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা নূরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের লাইনের পানি গায়ে লাগলে চুলকায়। এই পানি অনেকেই রান্নাবান্না বা খাবারের জন্য নেয়। আমি মনে করি, সিটি করপোরেশন পরীক্ষা না করিয়ে যে পানি দিচ্ছে তাতেই পানিবাহিত রোগ ছড়াচ্ছে। এর প্রধান কারণ পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে না দেখা। পানি বিশুদ্ধ উত্তোলন হলেও পরবর্তীতে যে পাইপের মাধ্যমে যাচ্ছে বা যে ট্যাংকিতে রাখা হচ্ছে সেটি দূষিত করছে কিনা সেটিও দেখা উচিত।
তিনি বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মতো একটি বড় প্রতিষ্ঠান পানি পরীক্ষা বন্ধ রাখছে। অন্য জেলার পৌরসভাগুলো পানি পরীক্ষা করাবে এটা অকল্পনীয়। তার ওপরে পরিবেশ অধিদপ্তরের ল্যাব বন্ধ। অর্থাৎ বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার প্রায় ১ কোটি মানুষ দূষিত পানি খেলেও কেউ তা দেখবে না। আমরা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছি।
বর্তমানে সিটি করপোরেশনে পানি পরীক্ষার কার্যক্রমের চেয়েও বড় কার্যক্রম নিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান উদ্দিন রোমেল। তিনি বলেন, আমানতগঞ্জের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন প্রশাসক স্যার। সেটি চালু হলে দূষিত পানি সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া এখনো ২৯টি প্রডাকশন টিউবওয়েল মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমরা বিভিন্ন বস্তি এলাকায় খোঁজ নিচ্ছি এবং ডার্মাটোলজিস্টের কাছ থেকেও জানতে পেরেছি, পানিবাহিত রোগ বেড়েছে। এই অবস্থায় পানি পরিশুদ্ধের কাজ করা হচ্ছে।
শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় নয় জেলা সদরগুলোতেও পানিবাহিত রোগের প্রার্দুভাব বেড়েছে। বিশেষ করে বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিতে ফি বছর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা বলেন, দূষিত পানি পান করলে সাধারণত টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, হেপাটাইটিস, গিয়ার্ডিয়া, ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। পটুয়াখালীতে বড় একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েল পানি উঠছে না। এজন্য মানুষ দূষিত পানি পান করছে বিভিন্ন উৎস থেকে। তারা পানি বাহিত বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।
এই চিকিৎসাবিদ মনে করেন, দৈবচয়নভিত্তিক হলেও বিভিন্ন উৎসের পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
ভোলা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মু. মনিরুল ইসলাম বলেন, সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে পানিবাহিত প্রকোপ উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি থাকে। শীতের সময়ে শিশুদের ডায়রিয়া বেশি হয়। এ ছাড়াও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের মাত্রা কিছুটা বেশি থাকে চরাঞ্চলে। এর প্রধান কারণ ওইসব অঞ্চলের মানুষ নদী, খালের পানি পান করেন। তারা দূষিত নাকি বিশুদ্ধ পানি পান করছেন তা জানে না।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশালের সভাপতি টুনু রাণী কর্মকার বলেন, এটি দুঃখজনক ব্যাপার যে পানির মতো স্পর্শকাতর একটি মৌলিক চাহিদার বিষয়ে সিটি করপোরেশন উদাসীন। নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নগর কর্তৃপক্ষ তৎপর থাকার কথা। কিন্তু ল্যাব বন্ধ এজন্য পানি পরীক্ষা বন্ধ থাকবে সেটি যৌক্তিক নয়। প্রয়োজনে অন্য কোনো ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন পানির বিল তো ঠিকই নিচ্ছে, তাহলে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে বাধা কোথায়? আমি মনে করি, পানি এবং স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কারো অবহেলা করা উচিত না।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশালের সভাপতি অধ্যাপক গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, পাকিস্তান আমলে দেখেছি রাস্তার পাশের হাইড্রেন্ট থেকে মানুষ পানি নিতো। সেই পানি সরকারি উদ্যোগে পরীক্ষা করিয়েও দেখা হতো বিশুদ্ধ কিনা। এখন তো মানুষ প্রকৃতির ক্ষতি করে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তুলছে। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ বা সরকারি সংস্থার পরীক্ষা করে দেখা উচিত এই পানি সুপেয় কিনা। এই বিষয়ে সুশীল সমাজ, নগরবাসী, গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর আরও সচেতনতা দরকার।
বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, পানির গুণগত মান পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায় ল্যাবটি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যন্ত্রপাতিগুলো চলে আসলে অচিরেই আমরা ল্যাবটি চালু করে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন পয়েন্টের পানি এনে গুণগত মান পরীক্ষা করতে পারবো।
উল্লেখ্য, জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর তথ্য অনুসারে বরিশাল বিভাগে ৯৩ লাখ ২৫ হাজার ৮২০ জনসংখ্যা বসবাস করে। এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য মাত্র একটি পানি পরীক্ষাগার।