গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে অস্থিরতা চলছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও দোকানি বলে দিচ্ছেন— তেল নেই। আবার কোথাও তেল পেতে গেলে সঙ্গে কিনতে হচ্ছে অন্য কোনও পণ্য। আবার কোথাও কোথাও অতিরিক্ত দামেও এই ভোজ্যতেল বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সয়াবিন তেল না পেয়ে অনেক গ্রাহক কিনে নিচ্ছেন রাইস ব্র্যান তেল (চালের কুড়ার তেল) কিংবা সরিষার তেল। সয়াবিনের এই ‘পাওয়া-না পাওয়া’ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষই।
এমন পরিস্থিতিতেই তিন দিন আগে গত ৯ ডিসেম্বর বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্য নিরসনে সরকার আবারও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয় ৮ টাকা করে। পাশাপাশি সয়াবিন তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি বাস্তবায়নে তিনটি সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে সরকারের এই দাম বাড়ানোর পরও বাজারে রয়েছে তেলের সংকট। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আবার পুরোনো মূল্যের তেলও এখন বেশ কয়েকটি দোকানে দেখা যাচ্ছে।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুর ১ ও ২ নম্বরের কাঁচাবাজার ও মহল্লার মুদি দোকান এবং শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও এলাকার কাঁচাবাজার সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
যা বলছেন বিক্রেতারা
মিরপুর ২ নম্বরের মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা সুমন বলেন, ‘আজ পর্যন্ত আমরা সয়াবিন তেল পাইনি। আরও ১০-১৫ দিন আগে অর্ডার দিয়েছি। কোম্পানির লোক বলে আজ আসবে, কাল আসবে, কিন্তু তেল আর আসে না।’
একই এলাকার জিদান জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা বলেন, ‘আমাদের এলাকার কোনও দোকানেই সয়াবিন তেল নেই। আমার দোকানে তো কোনও কোম্পানির লোকই আসেনি।’
মিরপুর ১ নম্বরের কাঁচাবাজারের সেলিম জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা মো. সেলিম বলেন, ‘আমরা তো তেল পাচ্ছি না। কোম্পানির কাছ থেকে তেল নিতে গেলে তাদের অন্য প্রোডাক্ট নিতেই হয়। গতকালও আমাকে এভাবে নিতে হয়েছে। আমাকে পোলাওয়ের চাল (আতপ) নিতে বলেছে। অথচ তাদের দেওয়া আগের চালই আমি এখনও বিক্রি করতে পারিনি। কিন্তু কিছু না নিলে তারা তেল দেবে না। তাই বাধ্য হয়ে সরিষার তেল নিয়েছি। আমাকে দুই কার্টন সয়াবিন তেলের সঙ্গে এক কার্টন সরিষার তেল কিনতে হয়েছে।’
নিউ সনিয়া জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা বলেন, ‘আমরা নতুন পুরান কোনও দামেরই তেল পাচ্ছি না। কোম্পানি তো আসছেই না। এক লিটারের তেলের বোতল ছিল কয়েকটা, বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কেউ এলে সরাসরি মানা করে দেই। মনে হয়, আগামী শনি-রবিবারের মধ্যে নতুন রেটের তেল আমাদের কাছে আসবে।’
নিউ বেবি ভ্যারাইটিজ স্টোরের বিক্রেতা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাছে পুরান রেটের তেল আছে। এই তেল নেওয়ার জন্য আমাকে সয়াবিনের সঙ্গে সরিষার তেল নিতে হয়েছে।’
নির্ধারিত মূল্যে (বোতলে উল্লেখিত মূল্য) বিক্রি করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার দোকান থেকে অন্য কিছু কিনলে আমি বোতলের গায়ের রেটেই বিক্রি করি। কিন্তু শুধু তেল কিনতে এলে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করি। কারণ আমার অন্য যে প্রোডাক্ট নিতে হয়েছে সেটার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য।’
বাজারটির আরও কয়েকটি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, তাদের দোকানে সয়াবিন তেল আছে। যা দুই দিন আগে ছিল না। এরকম একটি দোকান ইউনিক জেনারেল স্টোর। এই দোকানের বিক্রেতা বলেন, ‘এই কয়দিন আমার দোকানে তেল ছিল না। আমি বিক্রি করতে পারিনি। গতকাল রাতে আমাকে কোম্পানি এক লিটারের তেল দিয়ে গেছে।’
এগুলো নতুন দামের তেল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এগুলো আগের দামের তেলই দিয়ে গেছে। এতদিন কেন এই তেল আসেনি জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা তো আমার জানার কথা নয়।’
আবার নোয়াখালী জেনারেল স্টোরে তেলের খোঁজ করলে তারা বলেন, ‘আমাদের দোকানে তেল নেই। তবে যদি অন্য কোনও পণ্য কেনেন, আরেক জায়গা থেকে এনে দিতে পারবো।’
এদিকে শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও বাজারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। এতদিন তেল নেই বলা হলেও এখন সেখানে পুরোনো মূল্য বসানো তেলই বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারগুলোর মুদি দোকানের বিক্রেতারা বলছেন, ‘কোম্পানি থেকে আমাদের আগের দামের তেলগুলো এখন দিচ্ছে বলে বিক্রি করতে পারছি।’ তারা এও বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ুক বা কমুক সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। কারণ এখন মানুষ বেশি দামে খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন দরকার প্রোডাক্ট। প্রোডাক্ট থাকলে আমরাও ব্যবসা করতে পারবো; সেটা বেশি দাম হোক বা কম দাম হোক।’
বেসরকারি চাকরিজীবী আহসান হাবীব এসেছিলেন বাজার করতে। এ সময় তিনি বলেন, ‘কয়দিন পরপরই আমাদের বাজারে কোনও না কোনও সমস্যা লেগেই থাকে। এখন যেমন তেলের সমস্যা চলছে, তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি শিওর যে তেল আছে কিন্তু ব্যবসায়ীরা দিচ্ছে না। একই জিনিস নতুন লেবেল লাগিয়ে বেশি দামে বিক্রি করবে।’
মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘দোকান থেকে অন্য কিছু না কিনলে তেল বিক্রি করে না দোকানদাররা। এটা কেমন কথা? অন্য কিছু আমার না লাগলেও কী নিতে হবে?’
বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক হামিদুর রহমান বলেন, ‘সয়াবিন তেল না থাকাতে কয়েকদিন সরিষার তেল কিনেছি। কিন্তু এটা দিয়ে চালানো সম্ভব না। সরিষার তেলের দাম তো সয়াবিনের থেকে বেশি। বাধ্য হয়েই ওটা কিনতে হয়েছে।’
বাজার করতে আসা আরেক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সয়াবিন তেল কিনতে হলে অন্য কিছু কিনতে হবে, তাই কিনিনি। রাইস ব্র্যান কিনেছি।’
তেলের মূল্য নির্ধারণে সরকারের সিদ্ধান্ত
চলতি বছরের অক্টোবর থেকে সরকার সয়াবিন তেল এবং পাম তেলের সরবরাহে কিছু কর সুবিধা পুনর্বিবেচনা করেছিল। পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেল সরবরাহের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত মূসক ১৫ শতাংশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত ৫ শতাংশ মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া একই সময়ে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল এবং পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেলের আমদানিতে মূসক হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল। এই কর সুবিধাগুলো আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে বলেও জানানো হয়েছিল।
এদিকে ১৫ ডিসেম্বরের আগেই গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ভোজ্যতেল পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এ সময় বাণিজ্য সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিনসহ দেশের ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম হবে ১৭৫ টাকা। খোলা সয়াবিন বিক্রি হবে ১৫৭ টাকা দরে।’
উল্লেখ্য, এর আগে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হতো ১৪৯ টাকা লিটার দরে। এক্ষেত্রে দেখা যায় তেলের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে ৮ টাকা।
পুরোনো তেল এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে এমন প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, ‘এই তেলগুলো হয়তো কোথাও লুকানো ছিল, এটা হতে পারে। এটা আমার অনুমান।’
তেলের সঙ্গে ভোক্তাদের অন্য পণ্য কেনার বিষয়ে ভোক্তার মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা অভিযানে গেলে এগুলো নজরে রাখি। সুনির্দিষ্ট বলতে পারলে বা আমাদের কাছে তো তথ্য থাকতে হবে, তা না হলে আমরা গিয়ে একজনকে কী আর বলতে পারি। র্যান্ডম না সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমরা অভিযান করতে পারি। আর অন্য পণ্যের সঙ্গে বিক্রি করাটা অবৈধ। এখন আমি চাল কিনবো না তবুও আমাকে চাল কিনতে বাধ্য করা হবে, এটা তো কোনও সিস্টেমের মধ্যে পড়ে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন টিসিবি বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান যদি অনুমতি নিয়ে বলে যে পাঁচটা আইটেম এতো টাকা, সেটা আলাদা। আমি পাঁচটা কিনতে গেলাম না, কিন্তু আমাকে বললো যে বাকি চারটা কিনতে হবে সেটা তো অবৈধ বটেই। আমরা বৃহস্পতিবার এইসব বাজারে অভিযানে যাবো।’
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত