আবদুর রহমান নোমান, লালমোহন (ভোলা)
১৮ বছরের কিশোর মো. আরিফ। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র ছেলে। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। বাবা পেশায় দিনমজুর। আরিফকে নিয়েই বহু স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের। তাদের বৃদ্ধ বয়সে সংসারের হাল ধরবে আরিফ, এমন আশায় বুক বেধে ছিলেন বাবা-মা। তবে সেই স্বপ্ন গুলিতে বিদ্ধ হয়ে অকালেই নিভে গেছে। কিশোর আরিফ ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদপুর এলাকার সেকান্তর মুন্সি বাড়ির মো. ইউসুফের ছেলে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা-মা। নিজেদের অজান্তেই ছেলের মুখ এখনো ভেসে উঠে তাদের চোখে। ছেলের কথা মনে পড়লেই বুক ফাঁটা চাপা কান্না এবং চোখের পানিতে কাতর হয়ে পড়েন বাবা-মা।
কিশোর আরিফের বাবা মো. ইউসুফ জানান, আমার ছেলে খুবই ভালো ছিল। এলাকায় কোনো রাজনীতিও করতো না। পড়ালেখা আর সংসারেই ছিল তার সবচেয়ে বেশি মনযোগ। ২০২৩ সালে স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় পাস করে আলিমে ভর্তি হয়। তবে আমাদের সংসারে অভাব থাকায় সে দুই বছর আগে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে যাত্রাবাড়ির ৪ নম্বর গেট এলাকার একটি হোটেলে চাকরি নেয়। সেখান থেকে ৯ হাজার টাকা বেতন পেতো আরিফ। ওই বেতনের টাকা থেকে প্রতি মাসে সংসারের জন্য আমাকে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা দিতো। এতে করে আগের চেয়ে আরেকটু ভালো করে সংসার চালাতে পারতাম।
তিনি জানান, তবে গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) হোটেলের জন্য বাজার করতে গিয়ে যাত্রাবাড়িতে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আমার ছেলে আরিফ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। গুলি তার চোখের সামনে দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে মগজসহ বেরিয়ে যায়। দুপুরের দিকে ওই হোটেলের লোকজন এ ঘটনা মোবাইলে আমাকে জানায়। এ সংবাদ শুনে কোনোভাবেই আমার বিশ্বাস হয়নি। নিজেকে বুঝাতেই পারিনি আমার ছেলে মারা গেছে। পরে ধীরে ধীরে বিষয়টি মানতে হয়েছে। এরপর রোববার (২১ জুলাই) আরিফের প্রাণহীন দেহ আসে আমাদের বাড়িতে। পরে জানাযা শেষে তার লাশ দাফন করি। আরিফের মায়ের কান্না এখনো থামছে না। ছেলের কথা মনে করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছে সে।
সবশেষে ইউসুফ আরো জানান, আমার ছেলে তো কোনো দোষী না। তাহলে সে কেনো মরলো। এর দায় কে নেবে? এই ছেলেকে ঘিরেই বহু স্বপ্ন ছিল আমার। আমাদের বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র ছেলে আরিফই সংসারের হাল ধরতো। এখন কী হবে আমাদের? দুই মেয়ে পড়ালেখা করে। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটাবো তাই বুঝতে পারছি না। একদিকে নেই কোনো সম্পত্তি, অন্যদিকে আমি তো ছেলেকে হারিয়ে অসহায় হয়ে গেলাম। তবে সরকার যদি আমাদের কোনো সহযোগিতা করে তাহলে খুবই উপকার হবে।
শুধু আরিফ নয়, শুক্রবার (১৯ জুলাই) ঢাকাতে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন লালমোহন উপজেলার মোট সাতজন। তারা কেউই আন্দোলনকারী ছিল না বলে দাবি পরিবারের। ঢাকায় মর্মান্তিকভাবে মারা যাওয়া এমনই আরেকজন লালমোহন উপজেলার কালমা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ কালমা এলাকার হমজুউদ্দিন বাড়ির বজলুর রহমান বেপারির ছেলে মো. আকতার হোসেন (৩৫)। তিনি পেশায় ছিলেন অটোরিকশা চালক। ঢাকার মোহাম্মদপুরে গত ১৫ বছর ধরে ভাড়া নিয়ে অটোরিকশা চালাতেন আকতার হোসেন। তার স্ত্রীসহ এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। শুক্রবার (১৯ জুলাই) অটোরিকশা নিয়ে বের হয়ে চারটি গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এখন পুত্রবধূ এবং দুই নাতি-নাতিনের কী হবে তা নিয়ে চিন্তিত নিহত আকতারের দিনমজুর বাবা মো. বজলুর রহমান। ছোট্ট নাতি-নাতিনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে এই উপজেলার নিহত আরো পাঁচজনের মধ্যে ঢাকার রামপুরায় মোসলেহ উদ্দিন (৪০), শনির আখড়ায় মো. হাবিব (৪০), যাত্রাবাড়িতে হাফেজ মো. শাহাবুদ্দিন (৩৫), শাকিল (২০) এবং মো. সাইদুল (১২) নিহত হন। এদের মধ্যে মোসলেহউদ্দিন রামপুরার একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। তিনি উপজেলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের পাঙাশিয়া এলাকার মো. হানিফের ছেলে। এছাড়া শনির আখড়ায় মারা যাওয়া মো. হাবিব পেশায় ছিলেন একজন প্রাইভেটকার চালক। টাকার অভাবে তার লাশ এলাকায় আনতে পারেনি পরিবার। যার জন্য হাবিবের লাশ দাফন করা হয় ঢাকার জুরাইনে। তিনি লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চরমোল্লাজী এলাকার মো. শফিউল্যাহর ছেলে। অন্যদিকে যাত্রাবাড়িতে নিহত হাফেজ মো. শাহাবুদ্দিনও সেখানের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি লালমোহন উপজেলার কালমা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের লেজছকিনা এলাকার রদ্দি বাড়ির মো. খলিলের ছেলে। এছাড়া শাকিল ও সাইদুল পেশায় ছিল হোটেল কর্মচারী। এদের মধ্যে শাকিল লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের কাজিরাবাদ এলাকার মৃত দলিল উদ্দিনের ছেলে এবং সাইদুল কালমা ইউনিয়নের লেজছকনিা এলাকার মো. আকবর হোসেনের ছেলে।
এ বিষয়ে লালমোহন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মাহবুব উল আলম বলেন, ঢাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় এই উপজেলার মোট সাতজন নিহত হয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা তাদের ডাটা সংগ্রহ করেছি। এখনো এদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত