তিনি নিজে ছিলেন মাদকাসক্ত। একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নিজ জেলায় ফিরে এসে তার মত অসংখ্য মাদকাসক্ত তরুণকে ফিরিয়ে আনার কঠিন ব্রত নিয়ে চালু করলেন একটি ‘মাদকাসক্তি চিকিৎসা, সেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র’। সেই কেন্দ্রটি এখন জীবনের আশা ছেড়ে দেয়া মাদকাসক্ত তরুণদের দেখাচ্ছে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
২০১৯ সালের আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে শহরের পশ্চিম গোয়ালপাড়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে পথযাত্রা শুরু করে মাদকাসক্তি চিকিৎসা, সেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র ‘পুনর্জন্ম’। ঠাকুরগাঁওয়ের তরুণ কম্পিউটার প্রকৌশলী হাসান কবির শিহাব এর উদ্যোক্তা।
তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে। এরপর একটি কারিগরি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। হঠাৎ করেই তার সখ হয় রাজনীতি করার। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে ওঠা বসা করতে করতেই হয়ে পড়েন মাদকাসক্ত। নিজের উপার্জনের সব টাকা চলে যায় নেশার পেছনেই। ক্রমশঃ পরিবারেও তিনি বোঝা হয়ে ওঠেন। মেধাবী এ তরুণকে মাদক গ্রাস করে ফেলে। উপায়ন্তর না দেখে তার ভগ্নিপতি (কৃষিবিদ ডঃ মতিউর রহমানের ছেলে, যার ঢাকায় একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসা, সেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র রয়েছে) ব্যবসায়ী মাহাবুবুর রহমান রানা নিজের মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রে শিহাবকে ভর্তি করে দেন। দীর্ঘ আঠার মাস সেখানে অবস্থান করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন শিহাব, ফিরে আসেন ঠাকুরগাঁওয়ে। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেন একজন মাদকাসক্ত সন্তান একটি পরিবারের জন্য কতটা যন্ত্রণা বয়ে আনে। চোখের সামনেই অনেক সম্ভাবনাময় তরুণকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছেন মাদকের ছোবলে। তিনি তার অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মাদকাসক্ত তরুণদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এর পর ভগ্নিপতি মাহাবুবুর রহমান রানা,মামা মাহাবুবুর রহমান খোকন ও মামী আয়েশা সিদ্দিকা তুলির সহযোগিতায় গড়ে তোলেন এই মাদকাসক্তি চিকিৎসা, সেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র।
এ কেন্দ্রটি সরেজমিন পরিদর্শনের কালে দেখা যায় এখানে ১৯জন মাদকাসক্ত তরুণ ভর্তি আছেন। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে। প্রায় সবাই স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। ৫জন স্টাফ আর তিন জন চিকিৎসক প্রয়োজন অনুসারে কাজ করেন এখানে। এছাড়াও মুলত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠা তরুণরাই কাজ করে থাকেন। তাদের ভাষায় এটা হচ্ছে ফেলোশিপ জার্নি। এদের অনেকের সাথেই কথা বলে দেখা গেছে সবাই সপ্রতিভ এবং বুদ্ধিদীপ্ত। প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন যে তারা তাদের অতীত কর্মকাÐে অনুতপ্ত। এখান থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে তারা ফিরতে চান বলেও তারা জানান।
ঠাকুরগাঁও কেন্দ্রের পরিচালক শিহাব বলেন “এখান থেকে অনেকেই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন”। তিনি এ কেন্দ্রটির কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন “এখানে অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা চিকিৎসা, কাউন্সিলিং, ডিটক্সিফিকেশন, থেরাপিউটিক্যাল কমিউনিটি, সাইকো-এডুকেশন, অকুপেশনাল থেরাপি, রিক্রিয়েশনাল থেরাপি, আফটার কেয়ার ফলো-আপ সেবাগুলো দেয়া হয়ে থাকে। খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিহাব বলেন ঢাকা বা বড় শহরগুলোর এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক খরচ দিতে হলেও আমরা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যেই খরচের অংকটা রেখেছি। এখানে একজন নিবাসীর পেছনে মাসিক খরচ ২ হাজার হতে ৫ হাজারের মধ্যে। এ টাকার মধ্যে থাকা খাওয়া চিকিৎসাসহ আনুসাঙ্গিক খরচ নির্বাহ করা হয়। শিহাব বলেন, যদি আমরা সামান্য পরিমাণে হলেও সরকারি সাহায্য পেতাম তবে আরো সুন্দরভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হতাম।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও এর পরিদর্শক শফিকুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন “বেসরকারি এসব মাদকাসক্তি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারি ভাবে সাহায্য করার কোন সুযোগ নেই। পুনর্জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, সেটা হয়ে গেলেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারবো”।
মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই অবগত আছি। দিন দিন এর প্রসার ভয়াবহ রুপে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা রোধ করা যেমন জরুরি তেমনি জরুরি মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, সেবা ও পরামর্শের। দেশে মাত্র একটি সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র সারা দেশের মাদকসেবীর তুলনায় অপ্রতুল। এক্ষেত্রে বেসরকারি ভাবে এগিয়ে আসা কেন্দ্রগুলোর প্রতি সরকারি সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলে মনে করেন সচেতন মহল।