এক সময় ঢাকার গুলিস্তানে টুকরিতে করে জুতা বিক্রি করতেন। পাশাপাশি রাজনীতি করে একপর্যায়ে উপর মহলের আশীর্বাদে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি ও মেয়র হন। এরপর ভয়ংকর সন্ত্রাস ও অনিয়ম-দুর্নীতির পাখায় ভর করে রাতারাতি অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান দুই সহোদর আফজাল হোসেন ও আশরাফ হোসেন। দেশে-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক ওই দুই সহোদর সাভারে ‘ফেমাস সুজ লিমিটেড’ নামে আন্তর্জাতিকমানের একটি জুতার বিশাল কারখানাও স্থাপন করেছেন। চলতি বছরের ১৭ মে ওই জুতা কারখানাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। রাতারাতি এমন অঢেল সম্পদ ও বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়ায় নজর পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)।
এ দুজনের জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধানে পিছু নিয়ে দুদক ইতোমধ্যে মামলাও করেছে। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর এ দুই সহোদর কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সাবেক এমপি আফজাল হোসেন ও তার ছোট ভাই বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আনোয়ার হোসেন আশরাফ। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস ছিল না শত নির্যাতন-অত্যাচার ও ভূমিদস্যুতার শিকার হওয়া লোকজনদের। তবে জুলাই বিপ্লবের পর সম্পদের পাহাড় ফেলে আত্মগোপনে চলে যান প্রতাপশালী এই দুই সহোদর। যারা নিয়ন্ত্রণ করত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। আপন দুই ভাইয়ের নিপীড়ন-নির্যাতন ও ভূমিদস্যুতার শিকার লোকজন এখন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেছেন। একে একে বেরিয়ে আসছে তাদের ভয়ংকর সব অপরাধ ও দখলদারিত্বের ঘটনা।
দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা সদর বাজার এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা হয় সাবেক এমপি আফজাল হোসেনের দখলদারত্বের শিকার ওই এলাকার অধিবাসী গৌরাঙ্গ সরকারের সঙ্গে। টেলিভিশন মেকানিক গৌরাঙ্গ বলেন, বাজারের মধ্যখানে তার দুটি দোকানের ভিটি ছিল। সাবেক এমপি আফজাল তার সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর লোকজন লেলিয়ে দিয়ে ভিটি দুটি জোরপূর্বক দলিল করে নিয়ে তার হাতে মাত্র চার লাখ টাকা তুলে দেন। অথচ তখনই ওই ভিটির দাম লোকজন ৮০ লাখ টাকা হাঁকলেও তিনি বিক্রি করছিলেন না। দোকান ভিটি ফেরতের ব্যবস্থা করতে প্রশাসন ও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি। কথা হয় আফজালের ছোট ভাই সাবেক পৌর মেয়র আনোয়ার হোসেন আশরাফের সন্ত্রাসী বাহিনীর নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতনের শিকার উপজেলার পূর্ব ভাগলপুর গ্রামের অধিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, তার পৈতৃক জমি সন্ত্রাসী লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে দখল করতে আসেন পৌর মেয়র আশরাফ। এ সময় বাধা দিলে তাকে বর্বরোচিত নির্যাতন করা হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে মৃত ভেবে একপর্যায়ে রাস্তার ওপর ফেলে রাখে তারা। তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন।
আফজাল হোসেন ও আশরাফের প্রতিবেশী মনির হোসেন জানান, তিনি নিজের চোখে ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে আফজাল হোসেনকে টুকরিতে জুতা বিক্রি করতে দেখেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের টিকিটে আফজাল হোসেন ও আশরাফ এমপি এবং পৌর মেয়র হওয়ার পর আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। রাতারাতি অঢেল সম্পদ ও বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যান। বর্তমানে তাদের অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ঢাকা ও বাজিতপুরে প্রাসাদোপম বাড়ি রয়েছে। রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বাজিতপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালের সঙ্গে কথা হলে তিনি দাবি করেন, আফজাল হোসেন ও আশরাফের অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কাহিনী বলতে গেলে হাজার রজনী পার হবে। হেন কাজ নেই যে তারা করেননি। জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান শেষে ১৯ সেপ্টেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. জাভেদ হোসেন বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আশরাফের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এর আগে একই কারণে ২০২১ সালে আফজাল হোসেন এমপির জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধানে নামে দুদক এবং তার বিরুদ্ধেও মামলা করে।
- স্থাবর-অস্থাবর যত সম্পদ
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসন থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে এমপি হন আফজাল হোসেন। ২০১৪ সালের ১০ম ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন আফজাল। বিগত ১৫ বছরে অর্থ-সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তিনি। তার নির্বাচনি হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর ফুলবাড়ীয়া সিটি সুপার মার্কেটে আফজাল সুজ লিমিটেড এবং সাভারে ফেমাস সুজ লিমিটেড নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। ২০০৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী আফজাল হোসেনের একমাত্র আয়ের উৎস ব্যবসা থেকে আয় ছিল ১২ লাখ টাকা। ১৫ বছর পর আয়-ব্যয়ের হিসাবে ব্যবসা ছাড়াও যুক্ত হয়েছে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকান ভাড়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আফজাল সুজ লিমিটেড ও সংসদ-সদস্য হিসাবে সম্মানি ভাতা। এসব খাত থেকে এখন তার আয় ৫১ লাখ ৮ হাজার ২৭৫ টাকা।
২০০৮ সালে নিজের নামে নগদ ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ছিল। এখন তার নগদ টাকার পরিমাণ চার কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া নিজ ও স্ত্রীর নামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার শেয়ার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র। তার নিজের নামে আফজাল সুজ লিমিটেড, এনেঙো লিমিটেড, ফেমাস সুজ লিমিটেড, এসিএমই পেসটিসাইড লিমিটেড ও বিভিন্ন কোম্পানির মোট ৩ কোটি ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকার শেয়ার এবং স্ত্রীর নামে ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকার শেয়ার রয়েছে।
আফজাল হোসেনের স্থাবর সম্পদের মধ্যে ২০০৮ সালে ৪ একর কৃষি জমি, যৌথ মালিকানায় ২ একর কৃষি জমি, ৫ কাঠা অকৃষি জমি, ১২টি দোকান ও ৫ তলা একটি বাড়ি এবং স্ত্রীর নামে ৫টি দোকান ও ২টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। ২০২৩ সালে এসে তার স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নামে ৬৯৯.৫ শতাংশ কৃষি জমি ও ৬৪.৯৫ শতাংশ অকৃষি জমি এবং স্ত্রীর নামে ৯৮ শতাংশ অকৃষি জমি রয়েছে। তার নিজের নামে ২৪টি দোকান ও একটি মার্কেট এবং স্ত্রীর নামে ১৭টি দোকান রয়েছে। বাজিতপুরে তার গ্রামে একটি বাড়ি, ২টি ফ্ল্যাট এবং রাজধানীর আগামসি লেনে পাঁচতলা একটি বাড়ি, বনশ্রীতে ছয়তলা একটি বাড়ি ও বংশালে একটি পুরাতন বাড়ি রয়েছে। তার স্ত্রীর নামেও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০০৮ সালে মো. আফজাল হোসেনের ১০ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৫ টাকা ব্যাংক ঋণ থাকলেও এখন কোনো ব্যাংক ঋণ নেই।