বাংলাদেশে আসা টিকা নিয়ে ভয়ের কোন কারণ আছে?

12

বাংলাদেশে আজ থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন যুগের শুরু হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের দেহে দেওয়ার মাধ্যমে দেশব্যাপী টিকা কর্মসূচি শুরু হচ্ছে।

এ ভ্যাকসিন আনার শুরু থেকেই দেশের অনেকেই নানা প্রশ্ন তুলছেন। শঙ্কার কথাও সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন অনেকে। এ শঙ্কার বিষয়টি আসলে কী?

প্রিয়দেশ নিউজ এর এমন প্রশ্ন ছিল চিকিৎসক সোহরাব আলামিনের কাছে। তিনি বলেন, এটা আসলে প্রচারণার অভাবে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এটা একটা কারণ হতে পারে।

তিনি জানান, ভারতে দুটো ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে। এর একটি নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রচার হচ্ছে। সেখানে দুটো ভ্যাকসিনকেই সাধারণ জনগণ এমনকি প্রফেশনালরাও এক কাতারে গুলিয়ে ফেলছে।

‘কোভিশিল্ড আর কোভ্যাক্সিন এক কোম্পানির নয়। ভারত বায়োটেক উৎপাদিত কোভ্যাক্সিন নিয়ে খোদ ভারতেই বিতর্ক রয়েছে, সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড এর মান নিয়ে নয়। কিন্তু দুটো ভ্যাকসিনকেই মানুষ এক ভেবে গুলিয়ে ফেলছে’, বলেন এই চিকিৎসক।

বাংলাদেশ কোন ভ্যাকসিন আনছে
বাংলাদেশে প্রথমে ভারত সরকারের যে ভ্যাকসিন এসেছে সেটাও কোভিশিল্ড, সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত। এ ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর উৎপাদন ইংল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে হচ্ছে। এরমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট একটি। সেরামের এদেশীয় এজেন্ট বেক্সিমকো।

অন্যদিকে কোভ্যাক্সিন চূড়ান্ত অনুমোদনের পর স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও কার্যকারিতা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ ভারতের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য নজরদারি সংস্থা অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক থেকে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন প্রয়োগে কার্যকারিতা ডেটার তীব্র অভাব নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং সংক্রমণের সঠিক তথ্য না থাকলে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থাগুলির প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ হতে পারে।

বাংলাদেশ সেই কোভ্যাক্সিন আনেনি। বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড টিকার ব্যাপারে যোগাযোগ করেছে। সেই অনুযায়ী কোভিশিল্ড টিকা সময়মতো এসেছে বাংলাদেশে।

প্রথম টিকা কে নেবে? এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশে টিকা কার্যক্রমের শুরুর দিনে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টিকা নেবেন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরুনিকা কস্তা।

তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের চাপে নয় বরং সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে এ টিকা নিচ্ছেন। এমনটা জানিয়ে রুনু বেরুনিকা কস্তা বলেন, আমি স্বেচ্ছায় টিকা নিতে রাজি হয়েছি। টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা দূর করে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করাই আমার লক্ষ্য।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের এ সিনিয়র স্টাফ নার্স স্বেচ্ছায় প্রথম টিকা গ্রহণ করলেও এ নিয়ে বাকযুদ্ধ কম হয়নি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রথমে প্রধানমন্ত্রীকে টিকা নিতে বলেন। ভ্যাকসিন নিয়ে জনগণের ভয় দূর করা এবং টিকার কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য তিনি এ আহ্বান জানান। পরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একই সূরে কথা বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথমে বিএনপিকে টিকা নেওয়ার কথা বলেন।

এমন কথার জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার বিএনপিকে এত বছর গুম, খুন করে মেরেও মনের ক্ষোভ মেটাতে পারেনি। এখন তারা ভ্যাকসিন দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মারতে চাইছে।

তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভারত থেকে আসা ভ্যাকসিন সবার আগেই নিবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ভ্যাকসিন নেব, অবশ্যই নেব। আমি সবার আগেই নেব। আমার তো ভ্যাকসিন দরকার, আমার বয়স হয়েছে। আপনার (সাংবাদিক) লাগবে না। আমি বয়স্ক, আমার লাগবে। ভ্যাকসিন আসাটা ভালো। আমাদের অনেকেরই বয়স বেশি। ভ্যাকসিন সবার প্রয়োজন। ভ্যাকসিন নিলে আমরা আরও ভালো ফিল করব। কাজ করতে সুবিধা হবে। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে আমাদের প্রচেষ্টা আরও সহজ হবে।’

অন্যদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা জহিরুল কবির জহির বলেছেন, ‘আপনি (জাফরুল্লাহ) তো ডাক্তার মানুষ, খুব সহজেই ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারেন আর তাই প্রথম টিকা আপনাকে দিয়ে শুরু করলে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব খুশি হবো। সরকারের কাছে অনুরোধ জোর করে হলেও প্রথম টিকাটা যেন জাফরুল্লাহ সাহেবকে দেয়া হয়।’

এমন বাকযুদ্ধের মধ্যেই খবর আসলো দেশে করোনাভাইরাস এর প্রথম টিকা নিতে প্রস্তুত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরুনিকা কস্তা।

টিকা নিয়ে ভয়ের কারণ কী?
করোনাভাইরাস নিয়ে ভয়ের মূল কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয় দেখা দেওয়া।

কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন করে জার্মান গণমাধ্যম হ্যান্ডেলস্লাট ও বিল্ড। জার্মান পত্রিকা দুটির অনলাইন সংস্করণ প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক লোকদের জন্য কার্যকর নয়। এই টিকা হলেও তা সর্বোচ্চ ৮ কিংবা ১০ শতাংশের নিচে কার্যকর হতে পারে।

বিল্ড তার অনলাইন প্রতিবেদনে লিখেছে, জার্মান কর্তৃপক্ষ এমনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের জন্য কার্যকারিতার বিষয়ে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সির কাছ থেকে অনুমোদন নাও পেতে পারে।

তবে জার্মান গণমাধ্যমের এমন প্রতিবেদন পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রবীণদের মাঝে টিকার কার্যকারিতা বিষয়ে যে প্রতিবেদন করা হয়েছে তা ‘সম্পূর্ণ ভুল’।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও রক্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রবীণদের মাঝে প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখা গেছে। এ কারণে যুক্তরাজ্যের যৌথ টিকাদান কর্মসূচির কমিটি প্রবীণদের মাঝে এই টিকা প্রদান সমর্থনও করেছে।

এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। যদিও এটার সংখ্যা খুবই নগণ্য তবুও সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে নানা ধরণের প্রতিবেদন হচ্ছে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড মহামারি থেকে রক্ষায় দ্রুত টিকার ট্রায়াল এবং অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কিছুর বিকল্প ছিল না।

গত ৩০ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে সর্বপ্রথম অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার অনুমোদন দেয়। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা যৌথ উদ্যোগে এই টিকা তৈরি করেছে। করোনার এই টিকাকে সাধারণত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ মনে করা হচ্ছে।

টিকা ভারত থেকে নেওয়া হলো কেন
টিকা উৎপাদন হওয়ার মাঝপথে বাংলাদেশ দৌড়ঝাপ শুরু করে। তবে তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। বেক্সিমকোর নাজমুল হাসান পাপনের ভাষায়, ‘আমরা যখন টিকা কেনার দৌড়ে নামলা তখন দেখলাম কোনো ভ্যাকসিন নেই। উন্নত দেশগুলো আরও দেড় দুই বছর পর্যন্ত টিকা বুকিং দিয়ে রেখেছে। সবদিক ঘুরে পরে জানলাম ভারতের সেরামে ১০ কোটি ডোজ টিকা আছে। আমরা সেখান থেকে ৩ কোটি ডোজ আদায় করলাম।’

ভারত এ টিকা উৎপাদন না করলে আরও দুয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ টিকা পেত কি না এ নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের কথায়। সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান সতর্ক করে বলেন, ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন নিয়ে বিভাজন দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ভ্যাকসিনের ডোজ সমভাবে বিতরণে ব্যর্থ হলে বিশ্বকে কোটি কোটি ডলার অর্থনৈতিক খরচ মোকাবেলা করতে হবে। দিন চলে যাচ্ছে। করোনার টিকা পাওয়া ও না পাওয়ার মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক হচ্ছে। ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক দেশের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য ভ্যাকসিনের সমবণ্টনকে সমর্থন করতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এর রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা উদ্ধৃত করে টেডরস বলেন, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ৯.২ ট্রিলিয়ন ক্ষতি হবে। গত এক বছরে ২১ লাখেরও বেশি লোক করোনায় মারা গেছে। চলতি সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। তবে ভ্যাকসিন আমাদের আশা দিচ্ছে। এ কারণে আমরা এখন যে জীবন হারাচ্ছি তা আরো মর্মান্তিক হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে অবশ্যই আশা রাখতে হবে। পদক্ষেপও নিতে হবে।