সাত স্তরে যাচাই-বাছাই, শারীরিক যোগ্যতা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা এবং দুই দফা মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে ‘ভূমিহীন’ হওয়ায় চাকরি আটকে যাওয়া সেই আসপিয়া ইসলাম কাজলের পরিবারকে ঘর ও জমি দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। আর এতে অবসান ঘটছে কলেজছাত্রী আসপিয়ার পুলিশ কনেস্টবল পদে চাকরি পাওয়ার জটিলতা।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ থেকে আসপিয়ার পরিবারকে ঘর ও জমি দেয়ার বিষয়টি শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর ২টার দিকে সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বকুল চন্দ্র কবিরাজ।
ইউএনও বকুল চন্দ্র কবিরাজ বলেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যে আসপিয়ার পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়া হবে। আমি সকালে আসপিয়াকে কার্যালয়ে ডেকে বিস্তারিত জেনেছি। বিকেলে তাকে নিয়ে খাস জমি দেখতে যাব। জমি পছন্দ হলেই দ্রুত হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
তিনি আরও বলেন, জমি ও ঘর না থাকায় আসপিয়ার পুলিশে চাকরি পাওয়ার বিষয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হলে ভূমিহীন ওই পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর মাধ্যমে জমি ও ঘর প্রদানের জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশানুযায়ী নিয়োগের সময়সীমার মধ্যে দ্রুত সময়ে আসপিয়ার বা তার মায়ের নামে জমি ও ঘর হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এদিকে আসপিয়া ইসলাম কাজল যাতে তার যোগ্যতায় পুলিশ কনস্টবল পদে চাকরি পেতে পারে সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সকল ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে ফোন করে পুলিশ কনস্টবল পদে নিয়োগ পরীক্ষার রোল নম্বর থেকে শুরু করে সব ধরনের তথ্য নিয়েছেন। তারা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছেন বলে আসপিয়াকে জানিয়েছেন। এছাড়াও সরকারের অন্যান্য দপ্তর থেকে আসপিয়াকে ফোন করে তারাও সকল ঘটনা শুনে নিয়োগ পরীক্ষার সকল তথ্য নিয়েছেন। ফলে আসপিয়া তার চাকরি হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখছেন বলে শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুরে সংবাদকর্মীদের কাছে জানিয়েছেন।
কলেজ ছাত্রী আসপিয়া ইসলাম কাজল বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার বড় জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না গোবিন্দপুর গ্রামের মাতুব্বর বাড়ির বাসিন্দা। তারা (আসপিয়া) স্বপরিবারে মাতুব্বর বাড়ির মেজবাহ উদ্দিন অপুর বাড়িতে থাকেন।
আসপিয়ার এলাকা বড় জালিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ঝন্টু বেপারী বলেন, আসপিয়াকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর বাবা সৎ মানুষ ছিলেন। ২০১৯ সালের ৭ মে তার বাবা ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আসপিয়াসহ তাদের পরিবারের চারজন সদস্য ওই এলাকার ভোটার। তার বাবাও ওই এলাকার ভোটার ছিলেন। আসপিয়ার বড় ভাই ঢাকায় গার্মেন্টসে এবং মেঝ বোন একটি রেস্তোরাঁয় বাবুর্চির কাজ করেন। আর সেজ আসপিয়া ইসলাম কাজল হিজলা ডিগ্রি কলেজে বিএ-তে পড়াশোনা করছেন। ছোট বোন পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারা তাদের মা ঝর্না বেগমের সাথে হিজলায় বসবাস করছেন।
তিনি আরও বলেন, শফিকুল ইসলাম জীবিত অবস্থায় আমার সাথে আলাপ করে হিজলায় জমি ক্রয় করে ঘর তোলার জন্য সবকিছু ঠিক করেছিলেন। এমনকি জমিও পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে সে মারা যাওয়ায় সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে।
কলেজছাত্রী আসপিয়া বলেন, কোন ধরনের তদবির কিংবা সুপারিশ ছাড়া নিজের যোগ্যতায় সাতটি স্তর সফলভাবে অতিক্রম করার পর নিয়োগপত্র পাওয়ার মুহুর্তে তার সব স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছিলো। যে সময়টা হিজলা থানার ওসি তাকে জানিয়েছেন তোমার পরিবারের নিজস্ব জমি নেই, তাই তোমার চাকরিটা হচ্ছে না। এ কথা শোনার সাথে সাথে মনে হয়েছিল আমার মৃত্যু হচ্ছে। এ খবরটা তখন যে কতো কষ্টের ছিলো তা বোঝাতে পারবো না। কোন কিছু না ভেবে ছুটে যাই ডিআইজি স্যারের কাছে। তিনিও তার অপারগতার বিষয়টি তুলে ধরেন।
প্রসঙ্গত, পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে বরিশাল জেলায় ১০ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পুলিশ সদর দফতর। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বরিশাল জেলা থেকে টিআরসি পদে ৭ জন নারী ও ৪১ জন পুরুষ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী হিজলা থেকে অনলাইনে আবেদন করেন আসপিয়া ইসলাম। গত ১৪, ১৫ ও ১৬ নভেম্বর বরিশাল জেলা পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৭ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফলেও কৃতকার্য হন। ২৪ নভেম্বর পুলিশ লাইনসে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা তালিকায় পঞ্চম হন আসপিয়া। পরে ২৬ নভেম্বর পুলিশ লাইনসে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২৯ নভেম্বর মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে কৃতকার্য হন আসপিয়া।
তবে চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে নিয়োগ থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। কারণ তিনি বরিশাল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন। এই নিয়োগ পাওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) হিজলা থানার এসআই মো. আব্বাস পুলিশ ভেরিফিকেশনে আসপিয়া বরিশাল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নয় উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেন।
এরপর কলেজছাত্রী আসপিয়া ইসলাম যোগ্যতা বলে চাকরি পাওয়ার দাবি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) শেষ বিকেলে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামনের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেও নিরাশ হয়েছেন তিনি। এরপরই বিষয়টি নিয়ে আসপিয়ার ছবিসহ একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়নের সৃষ্টি করে। যে পোস্টের কমেন্টে খোদ বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান লিখেছেন, চাকরি হয়েছে জেলা ভিত্তিতে, যার সভাপতি সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার। আমি ডিআইজি, আমার কাছে অনেকেই জানতে চেয়েছেন।
কিন্তু বিষয়টি জানার আমার সুযোগ নেই। কারণ তার পুলিশ ভেরিফিকেশন চলছে। এটা গোপনীয় প্রক্রিয়া। মেয়েটা জানতে পেরেছে, বরিশালে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় নাকি তার চাকরি হচ্ছে না। সে জানতে এসেছিল। সে জানিয়েছে, তার বাবা-মা দুজনই ভোলা জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। তার বা তার বাবা-মায়ের বরিশালে কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, মানে জমি নেই। আমি তাকে ভেরফিকেশন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছি। পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। পুলিশ সুপারকে তার বিষয়টি আন্তরিকভাবে দেখতে বলেছি। ওনাকে পরামর্শ দিয়েছি, স্থায়ী ঠিকানা বা নাগরিকত্বের প্রমাণ বা উপায় বের করতে। বরিশালের ডিসিকে বিষয়টি জানিয়েছি। আসপিয়ার বিষয়টি পুলিশে চাকরি প্রত্যাশীদের কল্যাণে কাজে লাগবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।