নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
চট্টগ্রাম নগরীতে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাং। তুচ্ছ ঘটনায় মারামারি, খুনাখুনি চলছেই। গ্যাংয়ের কাছ থেকে পুলিশ, সংবাদকর্মী বা চিকিৎসক, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। শহরে একের পর এক অপকর্ম ঘটিয়ে চলেছে চাঁদাবাজ ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কিছুতেই যেন থামছে না তাদের দৌরাত্ম্য। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের পকেটগেট এলাকায় মেহেদী হাসান নামে এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে তারা। এ ঘটনায় রিফাত নামে আরেক তরুণ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনার পর থেকে চট্টগ্রামের ইপিজেড-বন্দর এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নানা আলোচনা করছেন। দায়িত্বশীলদের ভাষ্য, ইপিজেডের খুনের ঘটনাটি ‘ব্যক্তিগত ইস্যুকে’ কেন্দ্র করে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে আকমল আলী পকেটগেট এলাকা থেকে রিকশায় চড়ে মূল সড়কের দিকে যাচ্ছিলেন দুই তরুণ। এ সময় রেলবিট চার রাস্তার মোড় এলাকায় রিকশা থামিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় ৮ থেকে ১০ তরুণ ও কিশোর। হামলাকারীরা মূলত রিফাতকে লক্ষ্য করে হামলা চালালেও ছুরিকাঘাতে মেহেদি নিহত হন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, রেলবিট এলাকায় অবৈধ দোকানপাট ও ঘরবাড়ি ঘিরে বেশ কিছুদিন ধরে দুই গ্রুপের বিরোধ চলছে। সেখান থেকে চাঁদা আদায় কেন্দ্র করেই মূলত এ বিরোধ। যেখানে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত। খুনের ঘটনাটি ব্যক্তিগত ইস্যু কেন্দ্র করে হলেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা বলেন, সাদিক ও রমজান নামে দুই পোশাককর্মীর মধ্যে কারখানার ভেতরের ঘটনা নিয়ে ঝগড়া হয়। কারখানার কর্মী রিফাত তাদের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করছিলেন। তবে রিফাত রমজানের পক্ষ নিয়েছেন বলে সন্দেহ হয় সাদিকের। এজন্য সাদিক ইপিজেড এলাকার তার বন্ধুদের ঠিক করে রিফাতকে মারধর করার জন্য। কারখানা ছুটির পর সাদিকরা রিফাতের ওপর হামলা করে। সেখানে নিরীহ মেহেদি ছুরিকাঘাতের শিকার হন।
পাঁচ মাসে ৫ খুন
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নগরীতে দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে পাঁচটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খুলশী এলাকায় সাবেক এক কাউন্সিলরের অনুসারীদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে ছুরিকাঘাতে নিহত হন বেলাল নামে এক সিএনজিচালক। ১৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর খাজা রোডে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের হাতে খুন হন সাদ্দাত হোসেন নামে এক তরুণ। ১৪ মার্চ কালুরঘাট এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে খুন হন রিভারভিউ হোটেলের ব্যবস্থাপক মো. রিয়াদ। ৫ এপ্রিল আকবরশাহ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলার হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন ডা. কোরবান আলী এবং সবশেষ ইপিজেড এলাকায় নিহত হন মেহেদি হাসান। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামিদের তালিকায় বেশিরভাগই কিশোর।
মূলত ২০১৮ সালে জামাল খান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে গুলি করে হত্যার পর নগরী কিশোর গ্যাং আলোচনায় আসে। এর পরের বছর নগর পুলিশ এদের তালিকা করে। এরপর থেকে গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নতুন ভবন ও স্থাপনা নির্মাণে ইট-বালু সাপ্লাই বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কিছুর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এসব কিশোর অপরাধীকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কথিত রাজনৈতিক বড় ভাই ও কয়েকজন জনপ্রতিনিধি। যেখানে সরকারি বা খাসজমি দখল করে অবৈধ প্লট-বস্তি বাণিজ্য, ফুটপাত ও সড়কের দোকান থেকে চাঁদা আদায়, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপরাধমূলক কাজে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বড় ভাই মূলত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন। নগরীতে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুটি গ্রুপের শীর্ষ নেতার নাম ভাঙিয়ে চলে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ। বিভিন্ন অপরাধে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ জন নেতার নাম উঠে এসেছে আলোচনায়। গত ২৮ মার্চ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এছাড়া নানা সময়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন গ্রুপের বহু সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে।