ক্ষমতার পালাবদলের কারণেই কি চীন-মার্কিন সংঘাত?

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং-ই ২০১৮ সালে নিউ ইয়র্কে বলেছিলেন, একটা গ্লাস ভাঙা সহজ, কিন্তু জোড়া লাগানো কঠিন। আমাদের বর্তমান দূরত্ব হয়তো একসময় কমে আসবে, কিন্তু তা কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। আমাদের গ্লাসটা এখনও পুরোপুরি ভেঙে যায়নি ঠিকই, কিন্তু যে ফাটল ধরেছে তার দাগ থেকেই যাবে।

করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে, যা বিশ্বের মোট মৃতের সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। দুই দশক ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যত না আমেরিকান মারা গিয়েছিল, গত ছয় সপ্তাহে একটি অদৃশ্য ভাইরাসে তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে সেদেশে। আর যত বেশি বেশি মৃত্যু হচ্ছে, চীনের প্রতি আক্রমণের ভাষা ততই শাণিত করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা।

তাদের কথা – ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে চীন তা গোপন করেছে বলেই এই প্যানডেমিক, এবং এর দায় চীনকে নিতে হবে। বার্তা সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, চীন তাকে নভেম্বরের নির্বাচনে হারানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। “তারা (বেইজিং) সবকিছু করবে।”

কিন্তু এই সঙ্কটের মাঝে কেন চীনকে নিয়ে এতটা পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ? অনেক পর্যবেক্ষক এর পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দেখছেন। আসলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলতে চেয়েছেন যে, চীন উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ভাইরাসের কথা অনেকদিন চেপে রেখেছিল যাতে এর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। মার্কিন পত্র-পত্রিকায় খবর বের হতে শুরু করেছে, যেভাবে সরকার করোনাভাইরাস সামলাচ্ছ তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে যার প্রভাব নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। অর্থনীতি, কাজের সুযোগ বাড়ানোই ছিল  ট্রাম্পের রাজনীতির মুখ্য শক্তি, কিন্তু করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্দশা নির্বাচনের বছরে তাকে কোণঠাসা করে ফেলছে।

চীন তাকে নির্বাচনে হারাতে চাইছে এই কথা বলার দিনই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরীণ একটি নির্বাচনী জরিপ নিয়ে তার পরামর্শকদের বেশ গালমন্দ করেন বলে জানা গেছে।ঐ জরিপে বলা হয়েছে, ফ্লোরিডা, উইসকনসিন বা অ্যারিজোনার মত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে জেতা মি. ট্রাম্পের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে চীনকে কম-বেশি ইস্যু করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে কোন অজুহাতে চীনকে ঘায়েল করা এখন আমেরিকার জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িয়েছে।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) গ্রহণ করে, সেখানে চীনকে তারা তাদের প্রধান শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। “যে কোন সুযোগেই চীনকে কোণঠাসা করা, দুর্বল করার চেষ্টা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ওয়াশিংটনকে নতুন আরেকটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে।”

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলেন, চীন এই প্যানডেমিকের জন্য কতটা দায়ী যুক্তরাষ্ট্র তা তদন্ত করবে।

এদিকে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের তারবার্তায় দেখা যাচ্ছে চীনের উহানে একটি জীবাণু ল্যাবরেটরির জীবাণু সংক্রান্ত নিরাপত্তা নিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা চিন্তিত।

চীনের যে শহর থেকে বিশ্বের ১৮৫টি দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়েছে, ওই গবেষণাগারটি সেই উহান শহরেই অবস্থিত। বর্তমান মহামারির পটভূমিতে এই ল্যাবরেটরি থেকে জীবাণু বেরিয়ে আসার অভিযোগ বা জল্পনা আসলে কতটা সঠিক? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই ভাইরাস একটি ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে গেছে এমন অসমর্থিত রিপোর্ট তার সরকার খতিয়ে দেখছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্র ওইসব কূটনৈতিক তারবার্তা থেকে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৮ সালে আমেরিকার বিজ্ঞান বিষয়ক কূটনীতিকদের চীনের ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কয়েকবার সফরে পাঠানো হয়। ওই কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে দু’টি সতর্কবার্তা পাঠান যাতে ওই ল্যাবরেটরিতে নিরাপত্তার অভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
পত্রিকায় আরও বলা হয়, ওই কর্মকর্তারা উহান ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি (ডাব্লিউআইভি) নামে ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দুর্বলতার ব্যাপারে চিন্তিত এবং এ ব্যাপারে তারা আরও সাহায্য চেয়ে তারবার্তা পাঠান।এতে আরও বলা হয় ওই ল্যাবরেটরিতে বাদুড়ের করোনাভাইরাস নিয়ে যে গবেষণা চলছে তার থেকে সার্সের মত মহামারির ঝুঁকি নিয়ে ওই কূটনীতিকরা উদ্বিগ্ন ছিলেন।

ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ওই তারবার্তাগুলোকে কেন্দ্র করে আমেরিকান সরকারে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে যে বিশ্বের বর্তমান এই মহামারির কারণ উহানের ওই ল্যাবরেটরি অথবা সেখানকার অন্য আর কোন ল্যাবরেটরির ভাইরাস কি-না। পাশাপাশি আমেরিকার ফক্স সংবাদ চ্যানেলও এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ওই ল্যাবরেটরি বলে একটি তত্ত্ব তুলে ধরেছে।
এই প্রাদুর্ভাবের খবর জানা যায় গত বছরের শেষ দিকে, যখন শুরুতে বলা হয় এই ভাইরাস উহানের একটি খাবারের বাজার থেকে এসেছে।কিন্তু অনলাইনে এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা চললেও কোন ল্যাবরেটরি থেকে Sars-CoV-2 ভাইরাস (যার থেকে কোভিড-১৯ রোগ হয়) দুর্ঘটনাবশত বেরিয়ে গেছে, এর পক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

যেসব গবেষণাগারে ভাইরাস এবং জীবাণু নিয়ে কাজ করা হয়, সেখানে বিএসএল মানদণ্ডের নিরাপত্তা ব্যবহার করা হয়। বিএসএল দিয়ে জীবাণু বিষয়ক নিরাপত্তার মান বোঝানো হয়।এই মানদণ্ডের চারটি ধাপ আছে। এগুলো নির্ভর করে কী ধরনের জীবাণুর রসায়ন নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে এবং সেগুলো আলাদা অবস্থায় নিরাপদে রাখতে ক’ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

বিএসএল-১ ধাপটি সবচেয়ে নিচু মাত্রার এবং ব্যবহার করা হয় সেইসব ল্যাবরেটরিতে যেখানে পরিচিত সেইসব জীবাণু নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, যেসব জীবাণু মানুষের জন্য ঝুঁকির নয়। সর্বোচ্চ ধাপ অর্থাৎ বিএসএল-৪ ব্যবহার করা হয় সেইসব গবেষণাগারে যেখানে এমন জীবাণু নিয়ে কাজ করা হচ্ছে যার ক্ষেত্রে চরম সতর্কতার প্রয়োজন। অর্থাৎ চরম বিপদজনক জীবাণু যার মোকাবেলায় টিকা বা চিকিৎসা প্রায় নেই। যেমন ইবোলা, মারবার্গ ভাইরাস – এবং আমেরিকা ও রাশিয়ায় শুধুমাত্র দুটো ল্যাবরেটরিতে গুটিবসন্তের ক্ষেত্রে।

একই বিএসএল মান আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, যদিও দেশ ভেদে সামান্য কিছু তফাৎ থাকতে পারে।
“যেমন রাশিয়ায় সর্বোচ্চ সুরক্ষাসম্পন্ন গবেষণাগারকে বিএসএল-১ হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়। আর সবচেয়ে কম মাত্রার সুরক্ষা যেসব গবেষণাগারে প্রয়োজন, সেগুলো বিএসএল-৪ হিসাবে চিহ্ণিত করা হয় – একেবারে বিপরীত নম্বরের খাতিরে, কিন্তু যে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা মানের ক্ষেত্রে একেবারে এক,” বলছেন লন্ডনে কিংস কলেজের জৈব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. ফিলিপা লেন্তজস্।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন ধাপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে, কিন্তু নির্ধারিত মান কোনরকম চুক্তির মাধ্যমে বলবৎ করা হয়নি।

“এগুলো তৈরি করা হয়েছে কাজের পরিবেশ নিরাপদ রাখার স্বার্থে, যাতে ল্যাবরেটরিতে যারা কাজ করছেন তারা নিজেরা সংক্রমিত না হন এবং তাদের আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সংক্রমিত না করেন, এবং যাতে করে ল্যাবরেটরি থেকে জীবাণু দুর্ঘটনাবশত বাইরে চলে না যায়,” বলছেন ড. লেন্তজস্।

তবে তিনি বলছেন: “কেউ যদি আন্তর্জাতিক পার্টনারশিপে কোন একটা প্রকল্পে কাজ করে, তাহলে সেই প্রকল্পের অধীন ল্যাবরেটরিগুলোকে একটা নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যদি সেই প্রকল্পে আন্তর্জাতিক অর্থ সাহায্যের ব্যাপার থাকে।”

উহানের ডাব্লিউআইভি আমেরিকার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদান নিয়ে কাজ করছিল। আর সে কারণেই ওই তারবার্তায় উহানের গবেষণা কেন্দ্রকে আরও সহায়তা দেবার সুপারিশ করা হয়েছিল।

আসলে, ওয়াশিংটন পোস্টের খবর থেকে সেটা জানা যায়নি। তবে সাধারণভাবে বলতে গেলে জৈব কোন পদার্থ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করার নিরাপত্তা লংঘনের ঘটনা ঘটতে পারে বেশ কয়েকটি উপায়ে।

ড. লেন্তজস্-এর মতে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে: “ওই গবেষণাগারে কাদের প্রবেশাধিকার আছে, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ, তথ্য নথিভুক্ত করার পদ্ধতি, সাইন বসানো, জীবাণুর নমুনার হিসাব রাখা, দুর্ঘটনা ঘটলে তা জানানোর পদ্ধতি এবং আপদকালীন ব্যবস্থা – এসবের মাধ্যমে।” দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। ২০১৪ সালে ওয়াশিংটনে একটি গবেষণা কেন্দ্রের কাছে একটি কার্ডবোর্ড বাক্সে গুটিবসন্তের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো ভুলে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল।মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১৫ সালে দুর্ঘটনাবশত দেশের প্রায় দশটি ল্যাবরেটরিতে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে জীবন্ত অ্যানথ্র্যাক্স জীবাণুর নমুনা পাঠিয়েছিল।

অনেক দুর্ঘটনা ঘটে যায় কম ধাপের সুরক্ষা সম্বলিত অনেক ল্যাবে – যেগুলো খবরে আসে না। কিন্তু বিএসএল-৪ অর্থাৎ সবোর্চ্চ নিরাপত্তার ল্যাবরেটরির সংখ্যা পৃথিবীতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম – উইকিপিডিয়ার হিসাবে মাত্র ৫০টি, আর উহানের ওই গবেষণা কেন্দ্র তার একটি। এই গবেষণা কেন্দ্রগুলো তৈরি করতে হয় খুবই সতর্ক ব্যবস্থা নিয়ে – খু্বই উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে। কারণ এগুলোতে এমন জীবাণু নিয়ে কাজ হয়, যেগুলো বিজ্ঞানের নিরীখে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবাণু। ফলে এসব ল্যাবরেটরিতে নিরাপত্তার মান রাখতে হয় খুবই উঁচু। কাজেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পান থেকে চূণ খসলে তা নিয়ে তৈরি হয় উদ্বেগ।

কোনদিনই বিশ্বের কোথাও যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। “অনেকদিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতে সেই ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছে।”

“বিশেষ করে এখন আমেরিকান প্রশাসনের মধ্যে এমন একটি আশঙ্কা হয়তো দেখা দিয়েছে যে কোভিড-১৯ প্যানডেমিক মোকাবেলায় তাদের দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে বিশ্বের কাছে তাদের মর্যাদা, প্রতিপত্তি আরো ক্ষুণ্ণ হবে, এবং সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে চীন।”

কিন্তু মৌখিক যুদ্ধ ছাড়া চীনকে আর কীভাবে শায়েস্তা করতে পারে আমেরিকা?

আমেরিকা তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাথে নিয়ে চীনকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে একঘরে করার চেষ্টা করতে পারে। আর সেই সাথে সামরিক শক্তির মহড়া দেখিয়ে বেইজিংয়ের ওপর স্নায়ু চাপ বাড়ানোর পথও যে আমেরিকা নিতে পারে তার লক্ষণ গত সপ্তাহেই দেখা গেছে। মঙ্গল এবং বুধবার পরপর দুইদিন দক্ষিণ চীন সাগরের যে এলাকাটির ওপর চীন তাদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে, মার্কিন নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ সেখানে গিয়ে মহড়া দিয়েছে।

চীনের কূটনৈতিক জোট
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বহুজাতিক ফোরামকে ব্যবহার করে বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোকে সাথে নিয়ে একটা কূটনৈতিক জোট তৈরির পথে যেতে পারে চীন। তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের সাথে ৬০টিরও বেশি দেশ রয়েছে, যাদের সাথে এই কূটনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করতে পারে চীন।

“তবে চাপের কাছে নতি স্বীকারের মত কোন কিছু চীন দেখাবেনা। চীনের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি মনোভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায় যে, তারা বাইরের কোন চাপ আর মেনে নিতে রাজি নন।” সাম্প্রতিক সময়ে চীনা কূটনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।

তারা খোলাখুলি বলছেন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সময়মত ব্যবস্থা নেয়নি এবং সেই ব্যর্থতার দায় চীনের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। চীনের সরকারি বার্তা সংস্থা ৬ই এপ্রিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সরকারের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপের একটি টাইমলাইন প্রকাশ করেছে। সেটা দেখিয়ে চীনা সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কোন কিছুই গোপন করা হয়নি।

চীনের সরকারপন্থী দৈনিক ‘চায়না ডেইলি’ তাদের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “অনর্থক চীনকে দোষারোপ করা বন্ধ করতে হবে আমেরিকাকে। একটি প্যানডেমিক নিয়ে রাজনীতি করলে মানুষের প্রাণহানি বাড়বে ছাড়া অন্য কোন লাভ হবেনা।”

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং-ই ২০১৮ সালে নিউ ইয়র্কে বলেছিলেন, “একটা গ্লাস ভাঙা সহজ, কিন্তু জোড়া লাগানো কঠিন। আমাদের বর্তমান দূরত্ব হয়তো একসময় কমে আসবে, কিন্তু তা কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। আমাদের গ্লাসটা এখনও পুরোপুরি ভেঙে যায়নি ঠিকই, কিন্তু যে ফাটল ধরেছে তার দাগ থেকেই যাবে। ”

তার প্রমাণ মেলে সে বছরই , পরস্পরের উপর পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের মধ্য দিয়েই শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব। সর্বশেষ তা তীব্র আকার ধারণ করে চলতি বছরে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়।তবে এই সংঘাত মেটাতে উভয় পক্ষই গত এক বছর ধরে দেনদরবার চালিয়ে আসলেও কোন উপসংহারে পৌঁছাতে পারেনি। বরং গত মাসের শেষে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর নতুন করে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নেয়।

চীন-মার্কিন বাণিজ্য সংঘাত
২০১৮ সালের ৮ মার্চ ইউরোপ ও চীন থেকে আমদানী করা স্টিলে ২৫% ও এলুমিনিয়ামে ১০% অতিরিক্ত শুল্কারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২২ মার্চ ইউরোপের দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক বাতিলের ঘোষনা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীনের ওপর তা বহাল থাকে। একই দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ৫০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের আমাদানিকৃত চীনা পণ্যের ওপর শুল্কারোপের জন্য এক আদেশে সই করেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, চীন চুরি করছে! মানে, আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চীন মেধাসম্পদ চুরি ও স্থানান্তর করছে।

৩ এপ্রিল ২০১৮ চীনের ৫০০০ কোটি ডলারের পণ্যের নতুন তালিকা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। আর চীনও জবাব দিতে ছাড়েনি। তারা তৈরি করে সয়াবিন, গাড়ি বিমানসহ মার্কিন পণ্যের তালিকা। সেই মাসেই আমেরিকা থেকে আমদানি করা ১২৮ টি পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক বৃদ্ধি করে তারা, যার আর্থিক পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। ১৯ মে ২০১৮ মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি ঘোচাতে খসড়া চুক্তি সাক্ষরিত হয়। দু’দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা হবার পর সম্ভাব্য বাণিজ্য সংঘাত স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় উভয় পক্ষ। ফলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে শুরু করে। কিন্তু বিশ্ব শাসন করা এই দুই মোড়লের দ্বন্দ্ব তো এত সহজে মিটবার নয়।

১৫ জুন ২০১৮, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়ে বসেন। এবার ৫,০০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের উপর ২৫% আমদানী শুল্কারোপ করা হয়।

আর এই ঘোষণা অনুযায়ী ৬ জুলাই বার্ষিক ৩৪০০ কোটি ডলার বাণিজ্য হয় এমন ৮১৮টি চীনা পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক বসানো হয়। একই দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৪৫টি পণ্যের ওপরও চীন ২৫% শুল্ক আদায় শুরু করে।

২৩ আগস্ট ২০১৮ চীনের আরও ১৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্কারোপ কার্যকর করে যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে চীনও ১৬০০ কোটি ডলারের মার্কিন পণ্যে ২৫% শুল্কারোপ করে।

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, যুক্তরাষ্ট্র ২০,০০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্যের ওপর ১০% শুল্ক ঘোষণা করে । আরও ৬০০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্যে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়।

২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর- ১ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত হয় অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভাব প্রতিপত্তিশীল ১৯ টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের নিয়ে গঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। ঐ সম্মেলনে দুই দেশের নেতা বৈঠকে বসেন। ঐ বৈঠক থেকে জানানো হয় ৯০ দিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে শুল্কারোপ স্থগিত থাকবে। আর যদি এর মধ্যে কোন সমঝোতা না হয় ,তাহলে ২০% শুল্ক ধার্য করা হবে।

১ ডিসেম্বর ২০১৮ এই সংঘাতের তুঙ্গে ওঠে যখন ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগে কানাডায় চীনা মোবাইল কোম্পানি হুয়াওয়ের শীর্ষ নির্বাহী, মেং ওয়ানঝুকে আটক করা হয়। এই গ্রেপ্তারের পর অ্যাপল পণ্য বর্জন করতে শুরু করে চীনারা।

১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ সমঝোতার লক্ষ্যে নতুন করে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত বাতিল এবং নতুন করে আলোচনা শুরু করে উভয় পক্ষ। ৬ মার্চ ২০১৯ রেকর্ড পরিমান মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়, যার পরিমান দাঁড়ায় ৬২১ বিলিয়ন ডলার। ৫ মে ২০১৯ চীনের ২০,০০০ কোটি ডলার পণ্যের ওপর ১০% থেকে বাড়িয়ে ২৫% শুল্কারোপ করার সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রশাসন।

দুই দেশের বিরোধ মেটাতে উভয় পক্ষ পুণরায় ৯ মে ২০১৯ ওয়াশিংটনে বৈঠকে বসেন। কিন্তু কোন সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয় তাদের সেই আলোচনা। উপরন্তু বৈঠক শেষ হবার সাথে সাথে ট্রাম্প ২০,০০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে আমদানী শুল্কারোপের ঘোষণা আসে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে।

১৩ মে ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্রের ৬০,০০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্কারোপের ঘোষণা দেয় চীন। আর তা কার্যকর হয় ১ জুন ২০১৯ থেকে। ১৫ মে ২০১৯ ট্রাম্প প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে। এতে সরকারি অনুমোদন ছাড়া মার্কিন সংস্থা থেকে হুয়াওয়ের জন্য প্রযুক্তিসেবা নেওয়ার পথ বন্ধ করা হয়। হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান চীনের এ বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করছে।

চলতি বছরের ৩১ জুলাই চীন থেকে আমদানি করা আরও ৩০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর নতুন করে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে। চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপরই এই শুল্ক বসবে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কাপড়, সবই এবার শুল্কের আওতায় আসছে। প্রথমে ১০ শতাংশ হারে এই শুল্ক আরোপ হলেও পরে তা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই ২০১৯ এ চীনের সাংহাইতে শেষ হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিনিধিদের সপ্তাহব্যাপী আলোচনা। আর আলোচনা শেষ হবার পরপরই টুইট করে নতুন শুল্ক আরোপের বিষয়টি জানিয়ে দেন ট্রাম্প।

চীন-মার্কিনের সংঘাতমূলক অবস্থানের একটা উদাহরণ
বেইজিংয়ের রাশিয়ান যুদ্ধ বিমান সু-৩৫ এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণ যোগ্য এস-৪০০ প্রতিরক্ষা মিসাইল ক্রয়ের প্রতিক্রিয়ায় চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইকুইপমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ডিপাটমের্ন্টের উপর মার্কিন সরকার ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, ভারতও সে সময় রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। ব্যাপারটিতে চীন ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয় , যা মাকির্ন-চীন সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।

চীনকে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জিডিপির দেশ হিসেবে ধরা হয়। ২০ শতকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, তেমনি একুশ শতকে চীন হবে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ। লন্ডন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Centre for Economics and Business Research এর ২০১৯ সালের প্রকাশিত এক টেবিল (World Economic League Table 2019) থেকে জানা যায় , চীন ২০৩৩ সালের মধ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই প্রস্তুত।

এতে স্পষ্ট যে, চীনের দ্রুত উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সিংহাসনে চিড় ধরেছে। মার্কিনিদের সেই ইতিহাস নিশ্চয়ই জানা আছে যে, পূর্ববর্তী বাণিজ্য যুদ্ধ, যেমন- ১৯৮০ সালের রাশিয়ার শস্য নিষেধাজ্ঞা এবং ২০০৯ সালে চীনের সাথে ‘টায়ার বনাম মুরগী’র বিরোধ থেকে দেখা গেছে, একবার বাণিজ্যিক বাজার হারালে তা ফিরে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য, যা হয়তো আর কখনোই পুরোপুরি ফেরত পাওয়া যায় না।

তাই চীনের এই উত্থান অবশ্যম্ভাবী বা সময়ের দাবী, এটা জেনেই হয়তো চীনকে ‘শত্রু’ হিসেবে গণ্য না করার জন্য ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন খোদ মার্কিন বিশেষজ্ঞরাই। তাদের মধ্যে রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাটস এবং চীনের নীতি ও আচরণের সমালোচকেরাও রয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৮ সালে আগষ্টে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তাদের জীবিকা রক্ষা করার জন্য , ভূরাজনৈতিক সংঘাত শুরু করার জন্য নয়। এই ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনেক মার্কিনের জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাত হানতে পারে। এতে স্পষ্ট যে, জনগণের মতামত ছাড়াই এবং কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি পরিবর্তিত হয়েছে।