কোভিড-১৯ ও প্রকাশনা শিল্প

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি এমন কোন খাত নেই। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর প্রভাব অবধারিতভাবেই বাংলাদেশের বিশাল সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পে পড়েছে এবং এই আঘাতটা খুবই মারাত্মক।

লেখকের মস্তিস্কপ্রসুত ভাবনাগুলো একটা পূর্ণাঙ্গ বইয়ে রুপ নিতে মাঝখানের অনেকগুলো পর্ব সম্পৃক্ত। কম্পিউটার অপারেটর, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, কম্পোজার, প্রুফ রিডার, ছাপাখানার কর্মী, কাটার, বাইন্ডার- কত কিছু।

কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন এখন তো বইমেলার সময় না, তাহলে প্রকাশকদের ঝক্কিটা কেন এত বেশি হবে। মৌসুমী দু’চারজন প্রকাশকের কথা বাদ, কিন্তু সিংহভাগ মূলধারার প্রকাশকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকে। সারা বছরই এই মানুষগুলো কোন না কোন কাজ করে। লকডাউনে সব বন্ধ। স্বাস্থ্যবিধি মেনেও এসব কাজ চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। বই বিক্রি তো বন্ধই।

একেকজন প্রকাশকের কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩/৪শ কর্মী রয়েছে। কাজ বন্ধ থাকলেও এসব কর্মীর বেতন-ভাতা বন্ধ নেই। মানবিক কারণে নিজেরা বিপদে থাকলেও বিপদগ্রস্থ এসব মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেক প্রকাশক। কারণ এই মানুষগুলোর বেশিরভাগের সংসার-জীবন-জীবিকা এটার ওপরই নির্ভরশীল।

সরকারি প্রণোদনা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেয়া হচ্ছে। প্রকাশকদের জন্য কী দেয়া হবে এমন কোন কিছু চোখে পড়েনি। প্রণোদনা, বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে ঋণ তো আছেই,- দীর্ঘমেয়াদে কিছু ব্যবস্থাপনা বাঁচিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশের জ্ঞানের কারখানা এই শিল্পটিকে।

সরকার প্রতি বছর বই কিনে থাকে বিভিন্ন সরকারি গ্রন্থাগারের জন্য। নির্বাচিত বইটির ৭০/৭৫ কপি নেয়া হয়। এটা আসলেই অবিশ্বাস্য যে ১৬ কোটি মানুষের দেশে সরকারি গ্রন্থাগার রয়েছে মাত্র ৭০-৭২টি।

সামাজিক অবক্ষয়, জঙ্গি তৎপরতা, অপশিক্ষা, মানানসই নয় এমন সংস্কৃতির অনুকরণ, মাদক ইত্যাদি থেকে প্রজন্মকে সরিয়ে নিয়ে বইমুখো করতে পারলে আদতে লাভটা হয় জাতির। কিন্তু বইমুখো করার সেই সরকারি কাঠামো কোথায়? পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার আন্দোলন কোথায়!

যুগে যুগে বাজেটে সবচেয়ে অবহেলিত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। অথচ এই মন্ত্রনালয়ই সমন্বয় করে জাতির মেধা, মনন, সংস্কৃতি ও মানসিক উৎকর্ষের মত বিষয়গুলিকে। এদিকটায় বিশেষ নজর দেয়া জরুরি।

যেখানে গ্রাম পাঠাগার হওয়া দরকার ছিল, ইউনিয়ন পাঠাগার হওয়া দরকার ছিল- এগুলোর কিছুই নেই। অথচ মাঠ পর্যায়ে এমন সরকারি বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাঠাগারগুলো হতে পারত আগামী দিনে জ্ঞানে-গুনে শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নত সংস্কৃতির প্রজন্ম তৈরি করার মূল কেন্দ্র।
আমাদের তো উপজেলা পর্যায়েই সরকারি গণগ্রন্থাগার নেই। একটা জেলার লাখ লাখ মানুষের জন্য একটি সরকারি গণগ্রন্থাগার। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চাইলেও একজন শিক্ষার্থী, একজন গৃহিনী, একজন চাকরিপ্রার্থী, একজন বইপ্রেমী জ্ঞানের সাগরে ডুব দিয়ে নিজেকে শণিত করবার সুযোগ পান না। শুধু বই পড়ার জন্য গ্রাম, ইউনিয়ন বা উপজেলা থেকে জেলা শহরে যাওয়ার মতো বাস্তবতা অন্তত আমাদের এখানে নেই।

বাংলাদেশে ৪৯২টি উপজেলা রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে না হোক, অন্তত উপজেলা গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তারে এসব পাঠাগার হয়ে উঠবে মুক্তমনা মানুষের তীর্থক্ষেত্র। সেই সঙ্গে এসব পাঠাগারের জন্য সরকারি বই কেনা হলে আগের ৭২টি মিলিয়ে একজন লেখক ও প্রকাশকের একটি বইয়ের অন্তত ৫০০ কপিও বিক্রি হবে। যাতে লেখক রয়্যালটি পাবেন, আরও ভাল লেখায় উৎসাহিত হবেন, প্রকাশকও লাভবান হবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই মুক্ত বুদ্ধির চর্চাকে উৎসাহ দেন, তিনি নিজে বই লিখেন- বই পড়তে ভালবাসেন। এ বিষয়ে একমাত্র উনিই পারেন একটি যুগোপযোগী ও দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নিতে।

বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প আরও সমৃদ্ধ হোক। জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাড়ুক। গড়ে উঠুক জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক শক্তিমান আগামী প্রজন্ম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)