কোটায় ৪১ পেয়ে মেডিকেলে চান্স, ফের জোরালো হচ্ছে কোটাবিরোধী সুর

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গতকাল রোববার (১৯ জানুয়ারি)। সাধারণত ফল পরবর্তী সময়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়াদের মেধা ও তাদের সাফল্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। তবে এবার আলোচনায় কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বরণের ছয় মাস না পেরোতেই কোটার এই জয়জয়কার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। ফল পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ফলাফল পুনঃপ্রকাশের দাবি জানিয়েছেন মেডিকেল শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও।

তবে ফল প্রকাশের পর কোটায় সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়ার সুযোগ কতটা রয়েছে, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) আইনের কথা উল্লেখ করে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই ধরনের সুযোগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তা শুধু সন্তানদের জন্য বলে জানিয়েছে।

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছর ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭০ নম্বর পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ হারিয়েছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন কোটায় ৪১-৪৬ নম্বর পেয়ে আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। এতে যারা বেশি নম্বর পেয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৫৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে মোট পাঁচ হাজার ৩৮০টি আসন রয়েছে, যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ২৬৯টি এবং পশ্চাৎপদ জনগণের জন্য ৩৯টি আসন সংরক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধা কোটার ২৬৯টি আসনের মধ্যে ১৯৩ জন পরীক্ষায় পাস নম্বর পেয়েছেন, বাকি আসনগুলো মেধাতালিকা থেকে পূর্ণ করা হয়েছে।

শিক্ষার্থী, ছাত্র নেতা ও বিভিন্ন সংগঠনের ক্ষোভ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, ২৪ এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার শুরুটাই ছিল মূলত বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবি থেকে। এই কোটাব্যবস্থা বহাল থাকা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যা মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।

সংগঠনটির সদস্য (দফতর সেল) শাহাদাত হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সদ্য প্রকাশিত এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা ২০২৪-২৫ এর ফলাফল অনুযায়ী, কোটার বদৌলতে ১০০ নম্বরের মধ্যে কেবল ৪১-৪৬ নম্বর পেয়েও বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী। ফলে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নম্বর পেয়েও যোগ্য শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশেরই মেডিকেল কলেজে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এক ফেসবুক পোস্ট জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষায় এখনো কীসের কোটা? আজ থেকেই এই শোষণের শেষ হতে হবে। ফুলস্টপ।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার লিখেছেন, ‘৪১ পেয়ে না-কি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে কোটার জোরে, অথচ ৭৩ পেয়েও চান্স পায়নি! ছোটরা দাঁড়িয়ে যাও, পাশে থাকবো ইনশাআল্লাহ। গণঅভ্যুত্থানের সূচনা তো কোটা থেকেই।’

মেডিকেল পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মানববন্ধনে যোগ দিয়ে মাহিন সরকার বলেন, ‘উপদেষ্টা হিসাবে নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই থাকতে কেন আমাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে হলো। আমাদের দাবি মেনে নিন, নইলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব। আমরা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পুনঃপ্রকাশের দাবি জানাচ্ছি। সঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অযৌক্তিক সব কোটা বাতিল করতে হবে। তা না হলে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’

এদিকে ২০ জানুয়ারি সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোটা প্রথার নিরসন এবং মেডিকেল ভর্তির ফলাফল পুনঃপ্রকাশের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন মেডিকেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘মেডিকেলে কোটা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ -সহ নানা স্লোগান দেন।

পুনর্বিবেচনার সযোগ কতটুকু?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজন ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন, তাদের প্রাপ্ত নম্বর কত—সেগুলো খোঁজ নিতে হবে। এমন হওয়ার কথা ছিল না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে।

অপরদিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমিন বলেন, আমার সকাল বেলা বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছি। ভর্তির সম্পূর্ণ প্রসেসটি হয় বিএমডিসির নীতিমালার আলোকে। বিএমডিসির নীতিমালায় ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে নাতি-নাতিনির বিষয়টি কেন আলোচনায় আসছে আমার জানা নেই। এ সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও একটি প্রজ্ঞাপন রয়েছে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বিরঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতেও ৫ শতাংশ কোটা আছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্কোলারেও এটি আছে। বিএমডিসির নীতিমালা হওয়ার পর তা মন্ত্রণালয় থেকে এনড্রোস করা। এই ফলাফলটি সেই আলোকেই তৈরি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, কোটার শিক্ষার্থীরা এখনো ভর্তি হয়নি। তারা প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত। আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। তারা কাগজপত্র নিয়ে আসবে, আমরা তা ভ্যারিফাই করবো। সন্তান ছাড়া অন্য কারো এই কোটায় চান্স পাওয়ার সুযোগ নেই। এখন মন্ত্রণালয় থেকে যদি  বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধার সকল কোটা বন্ধ, তাহলে আমরাও তা বাতিল করে দেব। বিজ্ঞপ্তিতে বলাই আছে, পাওয়া না গেলে মেধা কোটায় নেওয়া হবে।

পুরাতন নীতিমালায় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের বাদ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসা শিক্ষা শাখার অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, কীভাবে বাদ দেব? বর্তমান নিয়মে, সন্তান-সন্তুতির বাইরে যদি কেউ থাকে তাহলে তারা বাদ পড়বে। বাকিটা সরকারি সিদ্ধান্ত। সরকার যদি বলে থাকবে না, তাহলে বাদ দেব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাদ যাবে কি না তা বিএমডিসির সিদ্ধান্ত। তারা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।