কে লিখবে মফস্বলের সংবাদকর্মীদের গল্প

16

গৌতম চন্দ্র বর্মন, ঠাকুরগাঁও: মা বলছে ছেলেকে, কিরে খোকা! এবার পূজোয় আমাকে শাড়ি কিনে দিবেতো ? সারাদিন ক্যামেরা-মাইক্রোফোন-হোন্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াস, রাতে ফিরে আমাকেতো টাকা দিস না, বৌমাকে টাকা রাখতে দিস তো, সামনে তো পূজা, কিছুইতো বলিস না, বুঝতে পারছি না?’

‘কী করবো বল মা, এটা যে আমার কর্তব্য, সময় মত খবর প্রকাশ না করতে পারলে চলবে কী করে। আমরা যে এ কাজের জন্য সামান্য কিছু সন্মানি পাই, আবার কেউ পায় না, মা। আর তুমি পূজায় শাড়ি চাচ্ছো, তাতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শুনছিলাম, মা, এবার নাকি সাংবাদিকরা করোনার কারণে প্রণোদনা পাবে, আমিও পাবো মনে করেছিলাম আর সে টাকা দিয়ে তোমাকে ভালো একটা শাড়ি কিনে দিব। কিন্তু সে টাকা আমি পেলাম না, তা বুঝতে পারলাম না মা।’

আর কে বা লিখবে আমাদের এসব কথা। স্ত্রীকে বলে, ‘রাখো তোমার এসব কথা, আগের রাতে নিউজ কভার করতে গিয়ে সারারাত ফিরলে না, ফোনটাও তোমার বন্ধ। তোমার চিন্তায় সারারাত আমি না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ আমাদের অপেক্ষার সন্মানি কী পেলাম? ছেলেটাও সারারাত বাবা বাবা বলে কাঁদছিল, পাবোই বা কী?’ আমি বলি, শোনো, আমরা সংবাদকর্মী, এটা নিয়ে ঠিকমতো অনেক অভিজ্ঞতার ব্যাপার বুক ফুলিয়ে বলতে তো পারো, আমার স্বামী একজন সংবাদকর্মী। আরো দশটা পেশার মত আমাদেরটাও দেশের জন্য খুবই দরকার। তোমরা খবর সংগ্রহ করে প্রিন্ট ইলেক্ট্রিক মিডিয়ায় প্রকাশ কর বলেই তো অন্যেরা ঘরে বসে সব কিছু জানতে পারো।’

‘এখান থেকে অনেক দূরে এখন কী হচ্ছে’, মা ছেলেকে বললো, ‘বাবা, সেদিন তোর ছেলেকে নিয়ে বাজারে গিয়েছিলাম নতুন জামার জন্য খুব বায়না ধরেছে, আর তুই যে টাকা দিয়েছিলি, তাতে জামা কিনে দিলে এমাস না খেয়ে থাকতে হতো। তাই আমি কোনো মতে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছি। তারপর তুমি সারাদিন না খেয়ে থাকলে আমি দুশ্চিন্তায় থাকি এই বুঝি তোর একটা কিছু হয়ে গেল। গত বছর ঝামেলায় জড়িয়ে পায়ের একটা চোট নিয়ে বাড়ি ফিরলি, এই রক্তের দাম কি কেউ তোকে দিয়েছে।’

ছেলে বলল, ‘ছেলের জন্য এত চিন্তা করো নাতো, মা।’ মা বলল, ‘না বাবা, আমার মত তুমিও একদিন যখন হবে তখন আমার কথা বুঝবে।’ ছেলে বলল, মা, তুমি আর তোমার নাতি এরকম করলে তোমার বৌমা তো ছেলেমানুষি করবেই, ওদেরকে তো তুমি ভরসা দিবে মা, আচ্ছা ঠিক আছে? সাবধানে থেকো, মা, এখনও যে করোনার উপদ্রব তাতে বাড়ি থেকে একদম বেরিও না। এখন আমি আসি মা, এই তোমরা খেয়ে নিও।’

ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন বছরের ছেলেটা হাতের আঙুল ধরে বলল, ‘আমার জন্য কী আনবে বাবা, আর কখন ফিরবে তুমি, জানো বাবা, তোমার যখন আসতে দেরি হয় তখন মা আর দিদি খুব চিন্তা করে।’ ছেলেকে বাবা বলে, ‘আচ্ছা বাবা, খুব তাড়াতাড়ি আসবো।’ এখন আসি একথা বলে বেরিয়ে যায় বাবা।

এরপর শুরু হয় জেলার সংবাদকর্মীর মত উপজেলার সংবাদকর্মীরা পাঠকের খবর জোগাড়ের দৌড়, এভাবেই প্রতিদিন তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে ওদের দেখা হয় কত শত খবর সংগ্রহ নিয়ে আসে তারা। আজ কে খুন হলো, কে মাঝ রাস্তায় পড়ে মারা গেল, কার নামের পাশে উপাধি যুক্ত হল, কোন শিশুটা রাস্তার পাশে জলসায় থেকে উদ্ধার হল। এতসব খবর ওরা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। আবার খবর মন মত না হলে শুনতে হয় অফিস থেকে নানা কথা।

কিছু ভুল খবর প্রকাশিত হলে জনগণের রেশে পড়তে হয় সংবাদকর্মীদের। খরা-বন্যা-বজ্রপাতে ওদের থামতে মানা, কারণ ওরা থেমে গেলে দেশ থেমে যাবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করবে কে? কখন কোথাও বিশাল কোন জনসভাতে উপরতলার মানুষের সামান্য কথা তুলে ধরবার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পুড়তে হয় তাদের। তবুও হয়তো অনেক সময় দেখা মিলে না উপর তলার লোকদের সাথে। আসলে ওদের নিজেদের কাজটাই ওরকম। সবার জন্য সমানভাবে খবর দেয়ার চেষ্টা করলেও সামান্যতম ভুলভ্রান্তিতে ওদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়, সঠিক খবর সঠিক সময় পৌঁছে দেয়ার জন্য বনে জঙ্গলে বাজারে শহরে নদীতে যেখানে সেখানে বিধি নিষেধ সত্ত্বেও ওদের চলতে হয়। দুই পক্ষের মাঝখানেও কখনও কখনও মাথা ফাটিয়ে আসতে হয় তাদের।

সংবাদকর্মীরা হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে প্রতি নিহতদের আপডেট জোগাড় করতে গিয়ে কতজন করোনায় পেশেন্ট হলো, করোনার পেশেন্ট নতুন কতজন হলো- আমরা বাড়িতে বসে সব পেয়ে যাই। তার জন্য ওরা প্রাণপণ লড়াই করে, ওরা জানের মায়া ত্যাগ করে ছুটতে থাকে শেষ দৃশ্যটা কাভার দেয়ার জন্য। ওরা সংবাদকর্মী রোবট না, তারপরেও ওদের নিয়ে মজা করে এবং ওদের কে নিয়ে অনেকে হাসাহাসিও করে অনেকে।

উপজেলার সাংবাদিকদের তো পরিবার আছে, তাদের জীবনের মূল্য আছে? কেনই বা পেল না করোনার প্রণোদনা সে কথা আজও ঘুরপাক খাচ্ছে? অথচ ওরা নিজেও জানে না আজ বেরিয়ে গেলেও আগামী কাল আদৌ ফিরবে কিনা।

সংবাদকর্মীদের শুধু বেতনভুক্ত কর্মচারী না ভেবে ওদেরও একটু সম্মান দিন। ওরা পেটের দায়ে এসব কাজ করছে, তা নয়, অনেক সাংবাদিক সন্মানি পর্যন্ত পায় না। ওরা একটা ভালোবাসার জায়গা অনেক পরিশ্রম করে তবেই এই জায়গা অর্জন করেছে।

আমরা তো বাড়িতে বসে এসব খবর দেখি আর ওরা মৌমাছির মতো খবর সংগ্রহ করে আনে। আমরা সব সময় সবকিছু সবার আগে জানতে পারি। তারপরও এবার করোনার সময় প্রণোদনা কেনই যে উপজেলা সংবাদকর্মীরা পেল না? মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, মাগো, অনেকেই সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরেন এই পেশা। এ মফস্বল সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষের নানা সমস্যার কথা লিখে। আর আমাদের মত মফস্বল সাংবাদকর্মীদের দুঃখ-কষ্টের খবর নিবে কে? মা, এমন প্রশ্ন শুধু নিজের প্রতি নিজেই করে থাকি।’