বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে পরীক্ষানির্ভর পদ্ধতির সফল উপস্থাপনের স্বীকৃতি হিসেবে দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অভিজিৎ ব্যানার্জি।
অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে পুরস্কার পেলেও নোবেল জয়ী সমগ্র বাঙালির তালিকায় তিনি চতুর্থ ব্যক্তি।
২০১৯ সালে তার সঙ্গে যৌথভাবে এ পুরস্কার পেয়েছেন আরও দু’জন: এসটার ডুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার।
এর আগে বাঙালি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অভিজিৎ ব্যানার্জির শিক্ষক অমর্ত্য সেন। নোবেল পাওয়া অন্য বাঙালিরা হলেন: সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিতে ড. মোহাম্মদ ইউনূস।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অভিজিৎ ব্যানার্জি ১৯৬১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন এই অর্থনীতিবিদের মা নির্মলাদেবী ছিলেন সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তার বাবা দীপক ব্যানার্জি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক।
অভিজিৎ ব্যানার্জির ছাত্রজীবন শুরু হয়েছিল কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। পরে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকে পড়াশোনা করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ১৯৮১ সালে স্নাতক হওয়ার পরে ১৯৮৩ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এরপর ১৯৮৮ সালে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন অভিজিৎ ব্যানার্জি। এছাড়া ২০১৫ পরবর্তী ডেভলপমেন্ট অ্যাজেন্ডা কর্মসূচিতে জাতিসংঘের সচিবের বিশিষ্ট প্রতিনিধি প্যানেলে ছিলেন তিনি।
অর্থনীতি বিষয়ে তার লেখা চারটি বই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তার মধ্যে ‘পুওর ইকোনোমি’ বইটি গোল্ডম্যান স্যাকস বিজনেস বুক সম্মানে ভূষিত হয়।
অভিজিৎ ব্যানার্জি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির ফুর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থনীতি বিভাগের একজন আন্তর্জাতিক অধ্যাপক। এছাড়াও অর্থনীতি বিশ্লেষণ ও উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ এর সাবেক প্রেসিডেন্ট, সেন্টার ফর ইকোনমিক পলিসি রিসার্চ, কিইল ইনস্টিটিউট, আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স এবং ইকোনমিক সোসাইটির সম্মানিত ফেলো। এছাড়াও তিনি পুর ইকোনমিকসের একজন সহকারী লেখকও।
২০১৯ সালে অভিজিৎ ব্যানার্জির সাথে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন তার স্ত্রী এসটার ডুফলো। স্ত্রী এসটারের জন্ম ১৯৭২ সালে প্যারিসে। অভিজিতের স্ত্রী এসটার ডুফলোর গবেষণাও যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি থেকে। এসটারের গবেষণার বিষয় ছিল, ‘দারিদ্র দূরীকরণে সামাজিক নীতি নির্ধারণ’।
দীর্ঘদিন সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন অভিজিৎ-এসটার দম্পতি।
এর আগে বিশ্বের দারিদ্র নিয়ে গবেষণার জন্যে ২০১৩ সালে অভিজিৎ এবং স্ত্রী এসটার যুগ্মভাবে গড়ে তোলেন ‘আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশান ল্যাব’।
২০১৫ সালে তাদের বিয়ে হয়, যদিও দু’জনের সম্পর্ক অনেক আগের। ২০১২ সালে এই দম্পতির এক সন্তান জন্মলাভ করে। এর আগে কলকাতার বাসিন্দা এবং বাল্যবান্ধবী ডাঃ অরুন্ধুতি তুলিকে বিয়ে করেছিলেন অভিজিৎ।
এসটার অর্থনীতিতে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী। বিশ্বের দ্বিতীয় নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন তিনি।
অর্থনীতিতে এবারের নোবেল পাওয়া এই তিন অর্থনীতিবিদের পরিচালিত গবেষণা বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বিমোচনের লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার রাখছে। তাদের পরীক্ষানির্ভর পদ্ধতি প্রয়োগ করে মাত্র দুই দশকে উন্নয়ন অর্থনীতি রূপান্তরিত হয়ে গেছে। বর্তমানে এই উন্নয়ন অর্থনীতিই হয়ে গেছে গবেষণার এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্র।
বিশ্বের ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ এখনো অত্যন্ত নিম্ন আয়ের জীবন ধারণ করছে। এখনো প্রতি বছর পঞ্চম জন্মদিন আসার আগেই মৃত্যু হয় অর্ধকোটি শিশুর। এদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু এমন রোগে যার চিকিৎসা বা প্রতিরোধ সম্ভব ছিল, চিকিৎসার খরচ আর কিছুটা কম হলেই।
এ বছরের নোবেল বিজয়ীরা তাদের গবেষণার মধ্য দিয়ে তথ্য সংগ্রহের নতুন এক ধরনের পদ্ধতি বের করেছেন, যার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ার সবচেয়ে ভালো উপায় কী হতে পারে তার নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া সম্ভব।
এ পদ্ধতিতে বৈশ্বিক দারিদ্র্যের মতো বড় ইস্যুটিকে ছোট ছোট গোছানো সম্ভব এমন প্রশ্নে বিভক্ত করা হয়। যেমন, শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে সবচেয়ে কার্যকর প্রক্রিয়া কী।
১৯৯০’র দশকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমার ও তার সহকর্মীরা গবেষণার মধ্য দিয়ে দেখালেন পরীক্ষানির্ভর পদ্ধতি ঠিক কতটা শক্তিশালী হতে পারে। তারা কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে কয়েকটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফলাফল ভালো করতে মাঠ পর্যায়ে বেশ কিছু প্রক্রিয়ার পরীক্ষা চালিয়ে এর সত্যতা প্রমাণ করেন।
ভারতীয় বাঙালি অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং তার স্ত্রী ফ্রান্সের এসটার ডুফলো মিলে অন্য বিভিন্ন দেশে অন্যান্য বিষয়ের ওপরও এমনই কিছু মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষানির্ভর গবেষণা করে সফল হন। এসব গবেষণার অনেকগুলোই তারা করেছেন ক্রেমারের সঙ্গে মিলে।
এই তিন জনের পরীক্ষানির্ভর গবেষণা পদ্ধতি বর্তমানে উন্নয়ন অর্থনীতিতে পুরোপুরিভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আছে।