কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ: টিআইবি

14

খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

মঙ্গলবার সকালে জুমে ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে নির্বাহী পরিচালক এ মন্তব্য করেন।

অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন দু্র্বলতার চিত্র উঠে এসেছে। এতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনসহ ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনগণের আমানতকৃত অর্থ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করলেও এই সঞ্চিত অর্থের ওপর আমানতকারীদের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমানতকারীদের পক্ষ থেকে এই আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু ব্যাংকিং খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমানতকারী তথা সাধারণ জনগণের অর্থ দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণের মাধ্যমে আত্মসাৎ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায়এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে বছরে গড়ে নয় হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ। যদিও জুনে এসে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির এই হার ৩১২ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। অপর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, আইএমএফের খেলাপি ঋণের এই পরিমাণের সঙ্গে অবলোপনকৃত ৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ যোগ করলে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ লক্ষ করা যায়। এক হচ্ছে বাহ্যিক প্রভাব যার মধ্যে রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক প্রভাব। আর অপরটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ যার মধ্যে রয়েছে তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি, নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকির কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি।

সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় টিআইবির ১০ দফা সুপারিশ
ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে; ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে; নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে; ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল গঠন করে সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে; রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে; ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে; তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।