কিশোরদের গ্যাং কালচার বাড়ার কারণ কী?

18

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে। ছুটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ কৈশোরে ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয়, তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়।সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়।সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় খেই হারিয়ে ফেলছে সমাজের কিশোর এবং তরুণেরা।যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট হেলথ’ একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে।এতে বলা হয়েছে, কৈশোর এখন শুরু হয় ১০ বছর বয়সে।যে কৈশোর দশ বছর থেকে শুরু হয়, সেই বয়স এখন আমাদের কাছে আতঙ্ক!পত্রিকার পাতা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম,গলির মোড় থেকে চায়ের দোকান, গণপরিবহন থেকে টকশো—সব জায়গায় ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।এই ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িতদের বয়স হচ্ছে ১০-১৭ বছর।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার উত্তরায় স্কুল পড়ুয়া এক কিশোর আদনান কবীরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর কিশোরদের গ্যাং সম্পর্কিত নানা তথ্য সামনে এসেছে। রাজধানীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। শুধুমাত্র ঢাকার ১০টি থানা এলাকাতেই রয়েছে ৩২টি গ্যাং। এই গ্যাংয়ে সক্রিয় রয়েছে ৫৫০ সদস্য। এখনই এদের লাগাম টানা না গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পুলিশের একটি সংস্থা। ওই সংস্থা একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। ইতিমধ্যে এ প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এই গ্যাং কালচার কতটা গড়ে উঠছে ঢাকায়? কেন-ই-বা বাড়ছে কিশোর গ্যাং?এর সমাধান কি?কিশোরদের সাথে কথোপকথনে কি জানা যায়?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে কিশোর অপরাধী চক্রের সূচনা হয় হয় উত্তরা থেকে। ওই এলাকায় ২০০১ সালে কাঁকড়া গ্রুপ নামে সংগঠিত হয় একদল বখাটে কিশোর। তাদের দেখাদেখি পরে ছোট-বড় আরো প্রায় ৩২টি কিশোর দুর্বৃত্তদলের উত্থান ঘটে।

কিশোর গ্যাংগুলো তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

খুলছে ফেসবুক পেইজ। তাদের মোটর রেস, উল্কি আঁকা, একসঙ্গে আড্ডা দেয়া, সড়কে জট বেঁধে মহড়া দেয়াসহ দল ভারির বিভিন্ন কার্যক্রম ফেসবুকে আপলোড করছে। এতে অন্য কিশোররাও এই গ্যাং পার্টির বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে ২৫শে মার্চের পর দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ কারণে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার চাপ নেই। আবার অনেক কিশোর করোনার কারণে কর্মসংস্থান হারিয়েছে। তারাই পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আড্ডা দিচ্ছে। ঘটাচ্ছে নানা অপরাধ।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার জানান, কিশোর গ্যাং রোধে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিট পুলিশিং কার্যক্রমকে জোরদার করা হয়েছে। ছোট গ্যাং হোক আর বড় গ্যাং হোক ঢাকায় কোনো গ্যাং পার্টি থাকবে না। 


কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দেয়ালে আকা গ্রাফিতি

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে ১৩টি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে সামাজিক অস্থিরতাসহ ওই এলাকায় বসবাসরত এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পুলিশের অভিযান ও কিছু কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পরও এ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ঢাকার সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত,   কোতোয়ালি, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান ও টঙ্গী থানা এলাকায় ৩২টি কিশোর গ্যাংয়ের ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ সদস্য বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা মোড়ে  মোড়ে আড্ডা দেয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি দেখার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, কখনো বড় মাপের সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের কারণে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাই, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় কিশোরী-তরুণীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১লা এপ্রিল ঢাকার পাশের জেলা  নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আদর্শনগর এলাকায় ৩০ বছর বয়সী শরিফ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গ্যাং কালচারের কারণে শরিফ মারা গেছে। গত ১০ই আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কদমরসুল কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম ওরফে নিহাদ (১৮) ও বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র জিসান আহম্মেদকে খুন করে। ৮ই সেপ্টেম্বর সবুজবাগ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে জব্বার আলী নামে আরেক কিশোর খুন হয়। গত ২৭শে আগস্ট উত্তরখানের খ্রিস্টানপাড়া ডাক্তার বাড়ি মোড় এলাকায় সোহাগ নামে এক কিশোর খুন হয়।

প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাং ঠেকাতে সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে- এ ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে বলা হয়েছে অভিভাবকদের। খারাপ প্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে সন্তানকে না মেশার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করার কথাও বলা হয়েছে। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ কিশোর গ্যাং নির্মূলে হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যেন কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করতে না পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অভিভাবকদের।

উত্তরার একজন বাসিন্দা বলছেন, “ফ্রেন্ডের সাথে বিবাদ মারামারি বা অস্ত্র পর্যন্ত কেন যাবে? কেন সেটা মৌখিকভাবে শেষ করা যায় না? এটা ভেবে দেখার বিষয় আসলে!” তিনি জানালেন তার ১৩ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে উদ্বেগে তিনি তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছেন।

“এই যুগের ছেলে-পেলেদের হাতের মুঠোয় থাকে ইন্টারনেট। তারা কী ধরনের সাইটে যায় সেটি ল্যাপটপ হিস্ট্রি দেখি। যেসব বন্ধুরা বাসায় আসে বা যেসব ফ্যামিলির সাথে ওঠাবসা এগুলো মনিটর করি।”

কিশোরদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়াও কিশোররা ইন্টারনেটে কী- ব্যবহার করছে তা অভিভাবকদের মনিটরিং করার পরামর্শ দেয়া হয়।

কেন-ই-বা বাড়ছে কিশোর গ্যাং? এর সমাধান কি? কিশোরদের সাথে কথোপকথনে কি জানা যায়?

সমাজবিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, আপনার সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সন্তানকে সময় দেওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মায়ের অবস্থান তুলে ধরা। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন খুবই জরুরি। এই বন্ধন যত হালকা হবে, সন্তান তত বাইরের দিকে ছুটবে, বাইরের কলুষিত বিষবাষ্প গ্রহণ করবে। তখন আর তাকে ফেরানোর কোনও রাস্তা থাকবে না।

আমরা নিশ্চয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের ইতিহাস জানি। তারপরও আরেকবার গল্পটা শুনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডের তরুণ এবং তাদের গ্যাংগুলো মারামারি আর ছুরি নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় প্রায়ই তারা ঝগড়া করতো, মারামারি করতো। এতে করে সাধারণ পথচারীরা তাদের যন্ত্রণায় অতীষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ বুদ্ধি করে একটা পরিকল্পনা করলেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় তারা বস্তিবাসী যুবকদের জন্য খেলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিলেন। তরুণ যুবকরা ধীরে ধীরে খেলা ও বিনোদনের জায়গাগুলোয় আসতে শুরু করলো। এতে করে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি বাদ দিয়ে খেলাতে বেশি সময় দেওয়া শুরু করলো। ঝগড়া, মারামারি, ছুরি সন্ত্রাসের জায়গা দখল করে নিলো ফুটবল। সেই সময় ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি নামের দুটি ক্লাব। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবলের অন্যতম শক্তিশালী দুটি ক্লাব। যে ক্লাবে অসংখ্য নামিদামি ফুটবলার তৈরি হয়।

বিভিন্ন-দেশে-কারাগারের-ভেতরে-সহিংসতার-ঘটনা-ঘটে

কিশোররা কথাপকথনের এক পর্যায়ে আমাকে প্রশ্ন করে, আপনারা আমাদের জন্য কী করেছেন? সব পত্রপত্রিকায় খালি একই ধরনের শিরোনাম। ‘কিশোর গ্যাং বাড়ছে’, ‘মাদকে আচ্ছন্ন কিশোর গ্যাং’, ‘গ্যাং কালচারে নষ্ট হচ্ছে সমাজ’, ‘ঢাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়’ ইত্যাদি। কেন এইসব কিশোর গ্যাং বাড়ছে, তা কি আপনারা খুঁজে বের করেছেন? জনসংখ্যার হিসাবে যেখানে ঢাকায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠ থাকার কথা ছিল, সেখানে দুই সিটি করপোরেশনে আছে মাত্র ২৩৫টি খেলার মাঠ, অর্থাৎ মাঠের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ১০০। তাহলে ছেলেমেয়েরা যাবে কোথায়? খেলার মাঠ নেই, পাঠাগার নেই, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই কোথাও। শুধু পড়াশোনার কথা বলে কিশোরদের আটকে রাখতে পারবেন? যেসব স্কুলে আমরা পড়াশোনা করি, সেসব স্কুলের বেশিরভাগেরই কোনও মাঠ নেই। তাহলে আমরা কোথায় খেলবো?

একটি বাচ্চা অসৎ পথে যাওয়ার পেছনে তার অভিভাবকের দায় অবশ্যই আছে, এটি আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করি না। কিন্তু সে বাচ্চা যে মাঠে খেলতে পারছে না, পাঠাগারে যেতে পারছে না, কোথাও তার আড্ডার জায়গা নেই, তা কেউ বলছে? বলছে না। একজন কিশোর পড়াশোনার বাইরে বাকি সময়টা কী করবে? স্কুলে যা আছে, তা হলো প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে কত ভালো করছে, কে কার চেয়ে কত ভালো করবে—এই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মানসিকতায় আমরা ক্লান্ত।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, এসব কিশোর আসলেই ভালো কিছু করতে চাইছে, ভালো কিছু জানতে চাইছে, ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে চাইছে কিন্তু তাদের করার সুযোগটা কোথায়? বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটিতে মাঠ আছে ২৩৫টি। কিন্তু এই মাঠগুলোর মধ্যে মাত্র ৪২টি মাঠে আছে সাধারণের প্রবেশ অধিকার। প্রতিষ্ঠানের অধিকারে মাঠ দখলে আছে ১৪১টি আর কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, যা ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কলোনির মানুষদের জন্য সংরক্ষিত। এর বাইরে ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি, যেখানে সুযোগ আছে খেলাধুলা করার। আর ১৬টি মাঠ দখল করে আছে কোনও না কোন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান।

এই যদি হয় শুধু একটি সিটি করপোরেশনের অবস্থা, তাহলে বাকিগুলোর কী অবস্থা? শুধু মাঠ নয়, পাঠাগারের অবস্থা আরও করুণ। একসময় ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৩টি পাঠাগার ছিল। বর্তমানে তা কমতে কমতে সাতটিতে এসে ঠেকেছে। এই সাতটিও নিয়মিত খোলা হয় না। নতুন বই কেনা হয় না বহুদিন।

শুধু ঢাকা সিটির পাঠাগারের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকি সিটি করপোরেশনের পাঠাগারগুলোর কী অবস্থা? যে প্রশ্ন নিয়ে আমি কিশোরদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেম সেই প্রশ্নের উত্তর তো আমি নিজেই পেয়ে যাচ্ছি। একজন কিশোর যদি কোথাও তার অবসর ফলপ্রসূভাবে কাটাতে না পারে, সে তো মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক গ্রুপ বা গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত হবে, এইটাই স্বাভাবিক।

আমরা সবাই বলছি ‘কিশোর গ্যাং’র অপরাধের কথা। তাদের বখে যাওয়ার কথা। কিন্তু কেন একজন কিশোর বখে যাচ্ছে, এটি আমরা ক’জন ভাবছি? সেই কিশোররা যদি এইভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিতো, তবে আমরাই কী ভাবতাম?

কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আরেকটি কারণ হলো, সমাজের অন্য সব অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া। আমরা বারে বারে বলছি মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। কিন্তু কেন কমেছে? মানবিক মূল্যবোধ হঠাৎ করে কমে গেছে বিষয়টা তাও নয়। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পেছনে অনেক ছোট ছোট ঘটনা দীর্ঘসময় ধরে ঘটতে থাকে। একদিনে কিশোর অপরাধ বড় আকার ধারণ করেনি। যে সমাজে ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না, ইভটিভিং-এর শাস্তি হয় না, মাদক সম্রাট দেশদরদি আখ্যা পায় সেই সমাজে অপরাধ বাড়বেই এইটা স্বাভাবিক। এটি আমার কথা নয়। এটি নিউটনের তৃতীয় সূত্র—‘প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ সেই সূত্র অনুযায়ী কিশোররা এসব দেখছে, জানছে। তারাও ভাবছে, এখানে অপরাধ করলে শাস্তি হয় না। এটা ভেবে তারাও অপরাধে জেনে অথবা না জেনে জড়িয়ে পড়ছে।

আরেকটি বিষয় সবচেয়ে শঙ্কার, তা হলো কিশোরদের সংশোধনাগার। যেসব কিশোরের সংশোধনাগারে নেওয়া হচ্ছে, তাদের জন্য কি সঠিক ব্যবস্থাপনা আছে? বিষয়টা যেন এমন না হয়, একজন কিশোর সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে এসে আরও খারাপ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই বিষয় নিয়ে আমাদের সবারই ভাবতে হবে। সংশোধনাগার বিষয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।

আমি যে এলাকায় থাকি, সেই এলাকার নাপিত আমার পেশা সম্পর্কে জানেন। তিনি একদিন আফসোস করে বলছেন, ছেলেকে আবার সংশোধনাগারে দিলাম। এটি আগেরটার চেয়ে ভালো। আমি কারণ জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, ছেলে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশছে তাই। আমার আগ্রহ দেখে তিনি বললেন, আমার ছেলে কোনও ধরনের নেশা করে না শুধু এলাকার খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে। আমি বলেও তাকে ওদের কাছ থেকে দূরে সরাতে পারি নাই।

আর এইসব খারাপ ছেলেরা সবরকম কাজ করতে পারে। তারা নেতার পেছনে মিছিলে দাঁড়ায়, আবার কোথাও মারামারি হলে তারা ছুটে যায়। এদের বাবা-মাও ওদের খবর রাখে না। পিচ্চি-পিচ্চি ছেলে, তারা না করে পড়াশোনা, না করে কাজ। খালি নেতার পেছনে ছুটে। আমি এই কারণে আমার ছেলেকে সরিয়ে ফেলছি।

যে কথাটা আমি আগেই বলেছিলাম যেকোনও অপরাধ একদিনে সংঘটিত হয়নি। সেই অপরাধের পেছনে অনেক বড়সময়েয় কোনও ছোট ছোট ঘটনা রয়েছে। সেই প্রমাণ পেলাম আমি নিজেই।

আমি বিশ্বাস করি, কিশোর অপরাধ কমিয়ে নির্মূল করা সম্ভব। কিশোর গ্যাং থেকে ফিরিয়ে এনে কিশোরদের শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এরজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের সদিচ্ছারও প্রয়োজন। ঘর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ সব জায়গায় কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে গান-নাচ-বাদ্যযন্ত্র শেখানো, আবৃত্তি, গল্প শোনা, গল্প বলা, গল্প বানানো, শব্দের খেলা, ছবি জোড়া দেওয়া, শারীরিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। প্রতিযোগিতা নয়, তারা কতটা সৃজনশীলভাবে তা শিখতে পেরেছে তা দেখা প্রয়োজন।

শিশু-কিশোরদের মোবাইল হাতে না দিয়ে বই পড়ায় উৎসাহী করে তুলতে হবে। তাদের নিয়েই মঞ্চনাটক, পথনাটকসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।

যদি একটি শিশু, শিশু বয়স থেকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, খেলাধূলা, থিয়েটার, সংগীত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকে, যদি তার মনস্তাত্ত্বিক জায়গা বুঝে তাকে গড়ে তোলা হয়, তবে তার কৈশোর ভালো কাটবে, আর কৈশোর ভালো কাটলে তার তারুণ্য হবে সবচেয়ে ফলপ্রসূ। এভাবে সুদীর্ঘ পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে কিশোরদের আলাদা করে গড়ে তুলতে হবে, তবেই কিশোর অপরাধ কমে যাবে। না হয় উত্তপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে যেখানে, সেখানে আর আমাদের কিশোরদের শক্তি হারিয়ে যাবে অতলে।