করোনাভাইরাস প্রতিরোধের উপায়

13

নুরুল আমিন: বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এটি এখন বিশ্ববাসীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বের সব দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে আতংকিত সবাই।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। যা ২০১৯-এনকোভ বা নোভেল করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটির নাম দিয়েছে ২০১৯-এনসিওভি। এই ভাইরাসে মানব দেহে আক্রান্ত রোগকে বলা হয় কোভিড-১৯। ভাইরাসটি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। যার কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এটি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া একান্ত জরুরি।

এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধ বা নির্মূল করার মতো কোন টিকা বা ভ্যাক্সিন বা কোন ওষুধ আবিস্কার করা সম্ভব হয়নি। এতে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। যে কোন বয়সের মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তি বা প্রাণীর সংস্পর্শে যে আসবে, সেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া হাঁচি-কাশি, বাতাস ও পানির মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। এমনকি ভাইরাস আছে এমন কিছু স্পর্শ করলে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। এতে সংক্রমণ ও বিস্তার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ল্যাটিন শব্দ করোনা থেকে ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়েছে। যার অর্থ মুকুট। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মতো। এর উপরিভাগে প্রোটিন সমৃদ্ধ। এই প্রোটিন আক্রান্ত হওয়া টিস্যু নষ্ট করে দেয়। কয়েক প্রজাতির করোনাভাইরাস রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, করোনাভাইরাস হচ্ছে নিদু ভাইরাস শ্রেণির করোনাভাইরাস পরিবারভুক্ত করোনা ভাইরিনা উপগোত্রের একটি সংক্রমণ প্রজাতি। এটি মূলত ভাইরাসের একটি উপপরিবার। ১৯৬০ এর দশকে প্রথম করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছিল। যা মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে দেখা যায়। পরে মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই এবং মনুষ্য করোনা ভাইরাস ওসি৪৩ নামে দুটি করোনা ভাইরাস। সাধারণ সর্দিকাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই ভাইরাস দুটি পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরও কিছু প্রজাতির সন্ধান মিলেছে।

এগুলো হচ্ছে- ২০০৩ সালে এসএআরএস-সিওভি, ২০০৪ সালে এইচসিওভি এনএল৬৩, ২০০৫ সালে এইচকেইউ১, ২০১২ সালে এমইআরএস-সিওভি এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে মিলেছে নোভেল করোনাভাইরাস। এসব ভাইরাসের মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপে দেখা দিয়েছে নোভেল করোনা ভাইরাস। যা অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলছে।

করোনাভাইরাসের জিনোম নিজস্ব আরএনএ দিয়ে গঠিত। যার আকার সাধারণত ২৬ থেকে ৩২ কিলো বেস পেয়ার এর মধ্যে হয়ে থাকে বা যার কোষের প্রস্থ ৪০০-৫০০ মাইক্রোমিটার। এই ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ। সাধারণত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, অবসাদ, ঠান্ডা বা সর্দিকাশি, শুষ্ক কাশি, শ্বাস কষ্ট, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। আবার কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর থাকে না। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। সংক্রমণের মারাত্মক পর্যায়ে রোগী অজ্ঞান হতে পারে। অঙ্গ অচল হতে পারে।

করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য ডিজিজ কন্ট্রোল রুম আইইডিসিআর এর নম্বরে কল করতে হবে বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। কল করার জন্য জরুরী একটি নম্বর ০১৯৩৭০০০০১১। নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করলেই চলবে। এটি রোগীর শ্বাসতন্ত্রে সংক্রামিত হয় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে অন্যজনের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটির উৎপত্তি সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি। তবে সাপ, বাদুড় বা অন্যকোন প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
দিন দিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এতে বিশ্ব পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। এর ভয়াবহ তান্ডবে বিশ্বের প্রবল পরাক্রমশালী শক্তিধর দেশগুলো পর্যন্ত নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে চীন থেকে শুরু হয়ে ইতালি, ইরান, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব, ব্রিটেন, কোরিয়া, ভারত, অস্ট্রিয়া, কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশসহ শতাধিক দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে। করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বিশ্বের অর্থনীতি, খেলাধুলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। এতে বিভিন্ন দেশে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সংক্রমণের ১৪ দিনের মধ্যে রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা যাবে। তবে কোন কোন বিশেষজ্ঞ পাঁচ দিনের মধ্যে আবার কেউ কেউ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে বলছেন।

করোনাভাইরাসের কোন ওষুধ ও প্রতিষেধক না থাকায় পরিচর্যা, সতর্কতা ও সচেতনতাই প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। এরজন্য বিশ্বব্যাপী দেয়া হচ্ছে সতর্কবার্তা। প্রতিষেধক ও ওষুধ তৈরির জন্য বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, হাঁচি-কাশিতে রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার করতে হবে, বাইরে ঘোরাফেরা-ভ্রমণ, ভিড় জমানো হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি, যেখানে সেখানে থুথু ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে, সাবান ও পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে হবে, জামাকাপড় পরিষ্কার করতে হবে, প্রত্যহ গোসল করার সময় সাবান ব্যবহার করতে হবে, অপরিষ্কার হাত দিয়ে নাক-মুখ ও চোখ স্পর্শ করা ঠিক হবে না, গরম পানি দিয়ে গড়গড়া কুলি করতে হবে, গরম পানি পান করতে হবে, বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে, আইসক্রিম বা ঠান্ডা জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে, ঠান্ডা যাতে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, যতটা সম্ভব সূর্যের আলোতে থাকতে হবে, অসুস্থ পশুপাখি থেকে দূরে থাকতে হবে, মাছ-গোস্ত ভালভাবে ধুয়ে সিদ্ধ করতে হবে, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে, কেউ আক্রান্ত হয়েছে এমন সন্দেহ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং রোগীকে হাসপাতালে বা ঘরে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে।

সাধারণত লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়। সঠিক সময়ে সঠিক সেবা ও চিকিৎসা পেলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এজন্য চিকিৎসকরা ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ও জিংক জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নিয়মিত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বিশেষ করে দৈনিক পাঁচবার ওযু করে নামাজ পড়লে করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ প্রতিহত করা সম্ভব। করোনাভাইরাসে আতংকিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া একান্ত জরুরি।

বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের কোয়ারান্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তাদের শরীরে করোনাভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছেন। রোগ নির্ণয়, রোগীর চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আরও জোরালো পদক্ষেপ নেবেন, পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সরবরাহ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগসহ কড়া নজরদারি ও সক্ষমতা বাড়াবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের মনে রাখতে হবে পরিচর্যা ও সচেতনতাই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও প্রাবন্ধিক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)