এবার ১৫ আগস্টের অজানা তথ্য দিলেন রাশেদ চৌধুরী

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক বদলে যাওয়ার দিন। এই দিনে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যদের। সেদিন সকাল থেকে রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছিল, শেখ মুজিব ইজ ডেড। কেনো শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ক্যু, কেনোইবা তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, শিশু শেখ রাসেলও কেনো হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো? সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের লাইভে এই বিষয়ে প্রথমবার মুখ খুললেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক)।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে লাইভে যুক্ত হন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা রাশেদ চৌধুরী। এই আলোচনায় তিনি জানান, কীভাবে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত হয়েছিলেন।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কেন ঘটালেন? জানতে চাইলে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা রাশেদ চৌধুরী বলেন, যুদ্ধের পর দেশের অবস্থা দেখে তারা হতাশ হন। ১৯৭২-৭৫ সালের দুর্ভিক্ষ ও লুটপাটের পরিস্থিতি তরুণ অফিসারদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। পরিবর্তনের উপায় নিয়ে গোপনে আলাপ চললেও সিনিয়ররা তা প্রকাশ করতেন না। ১৯৭৫ সালের ঘটনাটি আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হলেও বাকশাল গঠনের পর চিন্তাভাবনা আরও গভীর হয়। তবে আমি মূল পরিকল্পনার অংশ ছিলাম না, শুধু আলাপ-আলোচনা করতাম।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী জানান, ১৫ আগস্টের অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন ফারুক, আর রশিদের দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একত্রিত করা। শেখ মুজিবের বাসা, সেরনিয়াবাদ, রেডিও স্টেশন ও শেখ মনির বাসাকে টার্গেট করা হয়। মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন ও সেরনিয়াবাদের বাসার দায়িত্বে ছিলেন, আর রাশেদ চৌধুরী ছিলেন রেডিও স্টেশনে ডালিমের অধীনে।
তিনি বলেন, ভোরের দিকে রেডিও স্টেশন টেকেন ওভার করে ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং পরে ডালিম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘উই হ্যাভ ডান ইট।

অপারেশনে যাওয়ার আগে বিস্তারিত ব্রিফিং করা হয়নি জানিয়ে রাশেদ চৌধুরী বলেন, মুজিবের ভাগ্য কী হবে তা আমরা জানতাম না। মুজিবকে বাসায় মারার কোনো প্ল্যান ছিল না; পরিকল্পনা ছিল তাকে অ্যারেস্ট করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে এসে সামারি কোর্ট মার্শাল করা। রশিদ ও ফারুক ছিলেন অরিজিনাল প্ল্যানার। এরপর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রশিদ খন্দকার মোশতাককে নিয়ে রেডিও স্টেশনে আসেন এবং তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়; কারণ তিনি তখন বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট। এরপর রেডিও স্টেশনটি নতুন সরকারের হেডকোয়ার্টার হয়ে ওঠে।

রাশেদ চৌধুরী বলেন, মুজিবের বাসভবনে কী ঘটেছিল তা আমি সরাসরি দেখিনি, তবে পরবর্তীতে জানতে পেরেছি। আমার বইয়ে মেজর বজলুল হুদার স্টেটমেন্টে উল্লেখ রয়েছে, তিনি সৈন্য নিয়ে ভোরে মুজিবের বাসভবনে পৌঁছে সুবেদারকে জানান, আর্মি হ্যাজ টেকেন ওভার, মুজিব ইজ নো মোর ইন পাওয়ার। এরপর শেখ কামাল স্টেনগান নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিচে আসেন এবং তার স্ত্রী সুলতানা অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে দোতলা থেকে নিচে গুলি করতে শুরু করেন। এতে এক সিপাহী নিহত হন, কয়েকজন আহত হন; যা দেখে অন্যান্য সিপাহীরা ক্ষেপে যান।

বজলুল হুদার মতে, শেখ কামাল ও সুলতানা প্রথমে গোলাগুলি শুরু করেন। শেখ কামাল সিঁড়ি দিয়ে নিচে আসছিলেন, গুলি করতে করতে চিৎকার করছিলেন। দোতলা থেকে গুলি এসে এক সিপাহী মারা গেলে, একজন গালি দিয়ে বলেছিলেন, “শালার গোষ্ঠীসুদ্ধু মেরে দে।” শেখ মুজিবের বাসার চাকরও স্বীকার করেছে যে গোলাগুলি প্রথমে তারা শুরু করেছিলেন। পরে সিপাহীরা গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়, আর হুদা লোকজন নিয়ে প্রবেশ করেন। সে সময় শেখ কামাল মারা যান।

হুদার বরাত দিয়ে রাশেদ চৌধুরী বলেন, তিনি কয়েকজনকে নিয়ে উপরে গিয়ে শেখ মুজিবকে নামানোর চেষ্টা করেন, মেজর মহিউদ্দীনও সঙ্গে ছিলেন। শেখ মুজিব ঘর থেকে বের হলে, শেখ জামাল ও সুলতানা আবার উপর থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়েন। এক গুলিতে মুজিবের পেছনে থাকা সিপাহী পড়ে যায়। মুজিব দাঁড়িয়ে থাকলেও, হুদা আর মহিউদ্দীন ডাক করে নিজেদের বাঁচান। গুলির শব্দে লাঞ্চারের লোকজনও এসে পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে মুজিবের গায়ে গুলি লাগলে তিনি পড়ে যান।

শেখ রাসেলকে কেনো হত্যা করা হলো জানতে চাইলে রাশেদ চৌধুরী বলেন, সবাই দোতলার একটা রুমে বন্ধ ছিল। শেখ মুজিব পড়ে গেলে উপর থেকে জানালা দিয়ে গোলাগুলি শুরু হয়। বজলুল হুদার মতে, কয়েকজন সিপাহী জানালা দিয়ে গ্রেনেড ড্রপ করে। ওই গ্রেনেড ব্লাস্ট হয়ে বাকি সবাই একসঙ্গে মারা যায়। রাসেল নিচে আসেনি। শুধু শেখ কামাল নিচে মারা যায়। মুজিবের মৃত্যুর পর ফরেনসিক করলে হয়তো দেখা যেত তারা কীভাবে মারা গেছে, গুলিতে না গ্রেনেড বিস্ফোরণে।

ততক্ষণে রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছে, শেখ মুজিব ইজ ডেড, লাইভে বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক)।

পরবর্তী প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানারও সেদিন নাই হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এমন মনে হয়েছিল কি না-ইলিয়াস হোসেনের এই প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ চৌধুরী সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, সবাই বলে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, তবে তিনি মনে করেন মুজিবের মৃত্যু তার নিজের কারণেই হয়েছিল। মুজিবের ৪৪ মাসের শাসনে দেশের যে অবস্থা হয়েছিল, তার কারণেই তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। মুজিবকে জীবিত রেখে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না।

রাশেদ চৌধুরী মুজিবের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মুজিবের মৃত্যু এবং রাজনৈতিকভাবে নির্দোষদের মৃত্যু দুঃখজনক। তবে এমন ক্যুতে কিছু লোকের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়।

রাশেদ চৌধুরী বলেন, শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে ঢাকা ফিরে আসার পর জনগণের বিপুল ভালোবাসা পেয়েছিলেন; যা অন্য কোনো নেতা পায়নি। শেখ মুজিব একাত্তরের আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে তার শাসনভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। তিনি তখন গণতন্ত্রের পক্ষে না হয়ে, স্বৈরাচারী হয়ে উঠেন; যা ছিল খুবই আশ্চর্যজনক।