এক পরিবারের ৯ জনের মধ্যে ৬ জনের খোঁজ নেই

পরিবারের ৯ সদস্য মিলে বরগুনায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন ঢাকার মাদারটেকের পুতুল বেগম। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ পুতুল পরিবারের আরও দুই সদস্যের খোঁজ পেলেও বাকি ছয় জনের কোনো খবর জানেন না।

বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর) গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার পর চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে পুতুলের। ঘুম থেকে উঠে পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই পুতুল লাফিয়ে পড়েন নদীতে, কিন্তু তার আগেই আগুনের শিখায় পুড়ে যায় শরীরের বিভিন্ন অংশ। এখন তিনি বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।

রাতের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে পুতুল বলেন, তারা সবাই নিচতলার ডেকে এক জায়গায় ছিলেন। রাত তখন অনেক, সবাই ছিলেন ঘুমের মধ্যে।

তিনি বলেন, হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকার শুনে আমি লাফিয়ে পড়ি। অন্যরাও যে যার মত লাফিযে পড়ি। এরপর আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নিজের দুই সন্তান, মা, স্বামী, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী মিলে পরিবারের মোট ৯ সদস্য বরগুনায় বোনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন বলে জানালেন পুতুল। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত পরিবারের আরও দুই সদস্যের খোঁজ পেয়েছেন পুতুল বেগম, কিন্তু বাকি ছয় জনের কোনো খবর তিনি এখনও জানেন না।

বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে চারশর মত যাত্রী ছিল। তবে উদ্ধার পাওয়া যাত্রীরা বলছেন, আটশ থেকে এক হাজার আরোহী থাকার কথা।

অগ্নিকাণ্ডের সময়ে স্বামীসহ ইঞ্জিন কক্ষের কাছাকাছি জায়গাতেই ছিলেন আরেক নারী যাত্রী তাসলিমা বেগম। বিকট শব্দ শুনে কাছে এগোতে হইহুল্লোড়ে পেছনে ফিরতে হয় তাকে।

আগের জায়গায় ফিরে এসে দেখেন, তার স্বামী সেখানে নেই। অন্য অনেক যাত্রীর মত তাসলিমাও লাফিয়ে পড়েন নদীতে।

তিনি বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। আমি দেখতে যাচ্ছিলাম, কী হয়েছে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারি নাই। এসে দেখি জামাই নাই। আমি আমার জীবনরক্ষায় নদীতে লাফ দিই।

লাফিয়ে পড়লেও আগুনের লেলিহান শিখা থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাননি তাসলিমা। দগ্ধ শরীর নিয়ে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার।

চিকিৎসার জন্য কয়েক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন বরগুনার পাথরঘাটার বাসিন্দা তাসলিমা। তার স্বামীও দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

অভিযান-১০ লঞ্চে যখন আগুন লাগে, তখন তিনতলা লঞ্চের দোতলার ডেকে ছিলেন বরগুনার গোলাম মাওলা।

আগুন লাগার পরে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে নিচতলার ডেকে পড়েন যান তিনি। প্রাণ বাঁচানোর যাত্রায় অন্যদের সাথে লঞ্চের সামনের দিকে যেতে পারলেও এর মধ্যে পুড়েছে তার শরীর।

তিনি বলেন, ধাক্কাধাক্কি আর হুড়াহুড়ির মধ্যে লঞ্চ তীরে ভিড়লে আমি নামতে পারছি। কিন্তু এর মধ্যে শরীরে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

বৃহস্পতিবার রাতে চাঁদপুর থেকে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বরগুনায় মেয়ের শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছিলেন কৃষক বিল্লাল হোসেন (৫৬)। জানান, রাত ৩টায় সুগন্ধা নদীর ধানসিড়ি এলাকায় লঞ্চ আসার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লেগে ধোয়া বের হতে থাকলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে লঞ্চের ছাদে উঠেন তিনি। আগুন ছাদ পর্যন্ত পৌঁছালে স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৫০) ও মেয়েসহ নদীতে লাফ দেন। পরে সাঁতরে তীরে উঠলে মেয়েকে পেলেও স্ত্রীর সন্ধান পাননি।

নদী পাড়ে অপেক্ষায় থাকা আমেনা খাতুন জানান, তার ভাই ঢাকা থেকে লঞ্চে করে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।

তাদের মতো অনেকেই সন্ধান পাচ্ছে না স্বজনদের। তারা নিখোঁজ স্বজনদের জন্য আহাজারি করছেন।