নারী হওয়ার কারণে যিনি ‘আবহাওয়া বিজ্ঞানের জননী’ স্বীকৃতি পাননি

15
বিভিন্ন উদ্ভাবনের স্রষ্টাকে সাধারণত আমরা বলে থাকি জনক। যেমন— চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা, প্রাণিবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল।কেমন হতো, যদি এসবের উদ্ভাবক নারী হতেন? তবে কি আমরা তাদের জনকই বলতাম, নাকি স্ত্রী বাচকে রূপান্তর করে নামকরণ করতাম? নাকি এ ঝামেলা এড়াতে তাকে স্বীকৃতিই দিতাম না তার প্রাপ্য সম্মান ও কৃতিত্বের? আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের ইতিহাস কিন্তু এমনই বলছে।
আবহাওয়াবিদ্যা বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব শাখা, যার জন্য এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রাণিকূল বিরাজমান। যদি আবহাওয়া নিয়ে আমাদের কোনো ধারণা না থাকত, তবে কেমন হতো? উষ্ণাঞ্চলগুলো উষ্ণতর এবং শীতল অঞ্চলগুলি আরও শীতলতর হতে হতে একদিন পৃথিবী হয়ে যেত প্রাণবিহীন৷
প্রতি বছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু৷ গ্রিন হাউজ ইফেক্ট নিয়ে কমবেশি ধারণা আমাদের সবারই আছে। তবে, আমাদের মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে, সর্বপ্রথম কোথা থেকে এই ধারণা এল? কিংবা কে ছিলেন এই ব্যক্তি, যিনি প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন গ্রিন হাউজ গ্যাস পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলছে?
‘গ্রিন হাউজ’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে দ্বিমত থাকলেও সর্বপ্রথম যিনি ‘গ্রিন হাউজ গ্যাস ইফেক্ট’ নিয়ে ধারণা দেন, তার নাম ইউনিস নিউটন ফুট। যিনি শুধুমাত্র নারী হবার কারণে গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য সেসময় কোনো স্বীকৃতি পাননি।
জন্ম ও শুরুর কর্মজীবন
১৮১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গশেন শহরে জন্ম হলো এক শিশুকন্যার। নাম রাখা হলো ইউনিস নিউটন ফুট। ছয় বোন ও পাঁচ ভাইয়ের সাথে ইউনিসের বেড়ে ওঠা নিউইয়র্কের ব্লুমফিল্ডে। ইউনিসের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বেশিকিছু জানা না গেলেও গবেষকদল তার শুরুর কর্মজীবন নিয়ে কিছু তথ্য জানতে সক্ষম হয়েছেন।
১৮৩৬ সালে দিকে ইউনিস ফুট ভর্তি হন ‘ট্রয় ফিমেল সেমিনারি’ স্কুলে। নিউইয়র্কের ট্রয়ে অবস্থিত এই স্কুলই মেয়েদের জন্য নির্মিত প্রথম স্কুল, যেখানে ছেলেদের মতোই সমানভাবে মেয়েদেরকে শিক্ষা প্রদান করা হতো। এর পরিবর্তিত ও বর্তমান নাম এমা উইলার্ড স্কুল।
সেখানে ইউনিস প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী অ্যামস ইটনের কাছে বিজ্ঞানের দীক্ষা ও বিস্তার নিয়ে জ্ঞান লাভ করেন। স্কুলের পাশেই ছিল এক বিজ্ঞান কলেজ। বিজ্ঞান নিয়ে গভীরভাবে জানাশোনার জন্যই ‘ট্রয় ফিমেল সেমিনারি’র মেয়েদের পাশের কলেজে যাওয়ার অনুমতি মিলেছিল। সেখানেই ইউনিস প্রথম মৌলিক রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান নিয়ে ধারণা লাভ করেন।

উনিসই-প্রথম-পরিবেশের-গ্রিন-হাউজ-প্রভাব-ব্যাখ্যা-করেন
গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ধারণা
ইউনিস ফুট গ্রিন হাউজ ইফেক্টের এই পরীক্ষাটি করেছিলেন কাঁচা হাতে। তিনি তার কর্মজীবনে বিভিন্ন গ্যাসের উপর সূর্যরশ্মির প্রভাব পরীক্ষা করেছেন। এর জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন একটি বায়ু পাম্প, চারটি পারদ থার্মোমিটার, এবং দু’টি গ্লাস সিলিন্ডার। প্রথমে তিনি দুটো থার্মোমিটারকে দুটো সিলিন্ডারে রাখলেন। একটিকে বায়ুপাম্প দ্বারা বায়ুশূন্য এবং আরেকটিকে বায়ু দ্বারা ভর্তি করলেন। একই পরিমাণ তাপমাত্রা প্রদান করে দুটো সিলিন্ডারেই সামান্য তরল যোগ করে এদেরকে নিয়ে গেলেন সূর্যের আলোতে। সেখানে তিনি নিরীক্ষণ করতে থাকেন বিভিন্ন অবস্থায় তাপমাত্রার সূক্ষ্ম পার্থক্য।
তিনি এই পরীক্ষাটি করেছিলেন কার্বনিক এসিড, সাধারণ বায়ু এবং হাইড্রোজেনের উপর। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কার্বন ডাই অক্সাইডকে কার্বনিক এসিড বলা হতো। পরীক্ষা শেষে ইউনিস সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কার্বন ডাই  অক্সাইড ১২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত, অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি তাপ ধরে রাখতে পেরেছে।
এ পরীক্ষা থেকে তিনিই প্রথম ধারণা দেন যে, বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের অনুপাত কীভাবে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য দায়ী।

যে-স্কুলে-পড়েছিলেন-ইউনিস
বিস্তারিত কর্মজীবন
বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইউনিস নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আরো বিভিন্ন কাজকর্মে। সে সময় ইউরোপে তথা নারীদের ভোট প্রদানের অধিকার ছিল না। যারা ভোটাধিকার আদায় নিয়ে কাজ করতেন, তাদের বলা হতো Suffragist বা নারী ভোটাধিকার আন্দোলনকারী। নারীবাদের প্রথম ধাপ ছিল এই ভোটাধিকার আন্দোলন। তৎকালীন সমাজ এই আন্দোলনকারীদের ভালো চোখে দেখত না। তবুও সমাজের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ইউনিস নিজের গতিতে কাজ করে গেছেন। প্রখ্যাত সাফ্রেজিস্ট এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন ছিলেন তার ভালো বন্ধু।
ভোটাধিকারসহ নারীদের রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে ১৮৪৮ সালে আয়োজন করা হয় ‘সেনেকা কনভেনশন ফলস’। নারী অধিকারের উদ্দেশ্যে এটিই ছিল প্রথম কোনো জনসম্মেলন। সেখানে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জন নারী-পুরুষ। সেখানে ইউনিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং চুক্তিপত্রে তার স্বাক্ষরের সন্ধান পাওয়া যায়।

প্রথম সারির চতুর্থ অবস্থানে ইউনিসের স্বাক্ষর
বাধা যখন AAAS
বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম বিজ্ঞান সমাজটি হলো ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অভ সায়েন্স’ (সংক্ষেপে AAAS)। ঊনিশ শতকে সব বিজ্ঞাননির্ভর প্রতিষ্ঠান নতুন গবেষক এবং নারী বিজ্ঞানীদেরকে সদস্য না করলেও AAAS তাদের বিকাশে সাহায্য করত৷  ফুট ছিলেন AAAS-এর সম্মানিত নারী সদস্যের মধ্যে একজন।
ততদিনে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন পরিবেশের উপর গ্রিন হাউজ গ্যাসের ব্যাপক প্রভাব। তখন শুধু প্রকাশের অপেক্ষা। নিউইয়র্কের আলবেনিতে AAAS-এর এক সম্মেলনে ইউনিস তার পরীক্ষালব্ধ ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করতে চাইলেন। কিন্তু বাদ সাধল AAAS; কর্তৃপক্ষ অনুমতি প্রদান করল না।
আগস্ট, ১৮৫৬ সালে AAAS-এর বার্ষিক সম্মেলনে নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইউনিস তার কাজ প্রকাশ করার অনুমতি পেলেন। নিরীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করলেন ‘অ্যাফেক্টিং দ্য হিট অভ সান’স রেস’ শিরোনামে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ফুটকে তার নিজের আবিষ্কার উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়নি৷ এর পরিবর্তে স্মিথসোনিয়ান প্রতিষ্ঠানের জোসেফ হেনরি নামের একজন ইউনিসের লেখা সম্পাদনা করলেন৷ তিনি আরও জুড়ে দিলেন,
“বিজ্ঞান কোনো দেশ এবং নির্দিষ্ট লিঙ্গের জন্য নয়। নারীদের ক্ষেত্রেও এটি কেবল সুন্দর এবং দরকার ছাড়াও সত্যকেই আলিঙ্গন করে।”
নারীদের অবস্থান ও ঊনিশ শতক
তৎকালীন সমাজে প্রচুর লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। নারীদেরকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া দূরে থাক, বরং ছোট করে দেখা খুব ছিল সাধারণ ব্যাপার। জোসেফের একথায় ফুটের গবেষণা ও আবিষ্কারের প্রতি প্রশংসা খুঁজে পাওয়া গেলেও সত্যিকার অর্থে ফুটের কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখাই হয়নি।
বার্ষিক সম্মেলনে যেসব কাজ উপস্থাপন করা হতো, সে কাজগুলোই স্থান পেতো AAAS-এর তৎকালীন বার্ষিক সাময়িকী প্রসিডিংস-এ। বিজ্ঞানমনস্কদের কাছে এই জার্নাল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ এ জার্নালে ইউনিস ফুটের গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রভাব আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রকাশ করার কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
এর তিন বছর পর, ১৮৫৯ সালে এক আইরিশ বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল তার একই গবেষণা প্রকাশ করেন এবং তাকেই ‘আধুনিক আবহাওয়া বিজ্ঞানের জনক’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়!
কৃতিত্ব পুনরুদ্ধার
২০১১ সালে বহু বছর পর ইউনিস তার প্রাপ্য সম্মান পেলেন৷ রেইমন্ড সরেনসন নামক এক প্রাচীন বিজ্ঞান সাময়িকী সংগ্রাহক ১৮৫৬ সালে ইউনিসের পরীক্ষার ফলাফল পান, যা সংক্ষিপ্ত আকারে  প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এ।
সেখানে সরেনসন ‘সায়েন্টিফিক লেডিস’ তথা ‘নারী বৈজ্ঞানিক’ শিরোনামের একটি বিশেষ কলামের উপস্থিতি দেখান, যেখানে ইউনিসের কাজ প্রকাশ হয়েছিল। জার্নালের সম্পাদক এ ব্যাপারে বলেছিলেন,
“একজন নারী দ্বারা এই আবিষ্কার দেখে আমরা অত্যন্ত খুশি।”
এ ব্যাপারে সরেনসন দৃঢ়ভাবে ইউনিস ফুট সম্পর্কে জানিয়েছেন,
“কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো কিছু বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাস যে সৌরবিকিরণ করে তাপ উৎপন্ন করে  আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনিই প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী।”
১৫৫ বছর পর পৃথিবী থেকে যখন ইউনিস নিউটন ফুটের অস্তিত্ব বিলীন হবার পথে, তখনই সোরেনসন উন্মোচন করলেন সত্যের মোড়ক। নারীরা এখন মোটামুটি লিঙ্গ সমতা উপভোগ করলেও তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গায়। ২০২০ সালের হিসাবে, বিশ্বের ৩০ শতাংশেরও কম গবেষক হলেন মহিলা।
আশা করি, পৃথিবীতে একদিন সমতা বিধান হবে। সেদিন পর্যন্ত ইউনিস ফুটের মতো নীরব কণ্ঠগুলোকে  তাদের ন্যায্য পাওনার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
References:
  1. https://www.chemistryworld.com/culture/eunice-foote-the-mother-of-climate-change/4011315.article
  2. https://www.nytimes.com/2020/04/21/obituaries/eunice-foote-overlooked.html
  3. https://royalsocietypublishing.org/doi/10.1098/rsnr.2018.0066